ভারতের ইতিহাস বড় অদ্ভুত বিশেষ করে পূর্ব ভারতের। এই অঞ্চলের সীমান্ত নিয়ে য্যামন বিস্তর ওঠা নামা দেখতে পাওয়া যায় ত্যামনই এই অঞ্চলের বৈচিত্র। ভাষা, সংস্কৃতি,জীবনচর্চা, জীবনচর্যা, খানা-পিনা,বেশভুষা সবটুকুই পাল্টে পাল্টে যেতে থাকে। তাই তৎকালিন রাজা বা ভূস্বামীদের রুচি কিম্বা শাসন পদ্ধতিও পাল্টাবে এটা বলার অপেক্ষা রাখে না। কোনও কোনও প্রদেশ ছিল বহিঃশত্রুহীন চির শান্তির আবার বেশির ভাগ ভূখণ্ডের ছোট ছোট স্বাধীন রাজা নিজেদের মধ্যেই সীমানা বর্ধনের জন্য মাঝে মধ্যেই লড়াই-এ লিপ্ত হতেন। তবে পরিস্থিতির জটিলতা আসতে শুরু করে আফগান, মোগল তুর্কিদের আক্রমনের সঙ্গে। প্রাচীন পুঁথিপত্রকে অনুসরণ করে এই অঞ্চলের রাজারা যুদ্ধ কৌশল, রণনীতি, রাজনীতি দুর্গ সাজাতে শুরু করলেন।ভারতের মধ্যযুগের দুর্গগুলি সামরিক স্থাপত্যের ইতিহাসে একটি বিশিষ্ট স্থান দখল করে আছে। বিশেষত উত্তর-পূর্ব সীমান্তে উড়িষ্যার রাজাদের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আজও মানুষকে অবাক করে তোলে বৈকি। তৎকালিন রাজারা তাদের রাজধানী বা বাসভূমিকে আরও শক্তিশালী করার জন্য দুর্গ ছিল অপরিহার্য। সেই পরম্পরা অনুসরণ করে রাজারা রাইবনিয়া দুর্গকে কেন্দ্র করে উত্তর, দক্ষিণ, পূর্ব এবং উত্তর-পশ্চিম দিকে অনেকগুলি ছোট এবং বড় দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। তবে এই দুর্গগুলির অধিকাংশই এখন পশ্চিমবঙ্গের মেদিনীপুর জেলার অধীন। উড়িষ্যার শেষ হিন্দু শাসক মুকুন্দদেবের শাসন পর্যন্ত উড়িষ্যার সকল শাসকের অধীনে রাইবনিয়া একটি উল্লেখযোগ্য সামরিক ঘাঁটি হিসাবে অব্যাহত ছিল।
রাজা ও সৈন্যদের নিরাপত্তার জন্য দূর্গ নির্মাণের বিধান দেওয়া হয়েছে। রাজার তাঁর রাজ্যের জন্য দূর্গের প্রয়োজনীয়তা অবসম্ভাবী।দূর্গই যেহেতু রাজার বাসস্থান সেই জন্য তাঁর বাসগৃহটি সর্বতোভাবে সুখকর ও মনোহর ফল, পুষ্প সমন্বিত, রমনীর উদ্যান ও সরোবর যুক্ত, প্রচুর আলো বাতাস ও জল সম্পন্ন এবং সুরক্ষিত, সুসজ্জিত ও সর্ব ঋতুতে আরামদায়ক কক্ষ বিশিষ্ট হবে। এছাড়া দূর্গে যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র, ধন, ধান্য, অশ্বাদিবাহন, ব্রাহ্মন, কারিগর, খাদ্য, পানীয় অবশ্যই থাকবে। মনুসংহিতায় রাজাকে গিরিদূর্গে আশ্রয় নেবার উপদেশ দেওয়া হয়েছে।
শস্য উৎপাদনের জন্যই মনু রাজাকে গিরিদুর্গ আশ্রয় করে বসবাস করার উপদেশ দিয়েছেন।
মহাভারতে মরুদুর্গ, ভূমিদুর্গ, গিরিদুর্গ, মনুষ্যদুর্গ, মৃত্তিকা দুর্গ ও বনদুর্গ এই ছয়প্রকার দুর্গের উল্লেখ আছে-
“ধন্বদুর্গং মহীদুর্গং গিরিদুর্গং তথৈব চ।
মনুষ্যদুর্গং মৃদ্ দুর্গং বনদুর্গঞ্চ তানি ষট্।।”
যদিও মহাভারতে কিন্তু 'নৃ'দুর্গকেই শ্রেষ্ঠ দুর্গ বলা হয়েছে। কারণ হস্তী, অশ্ব, রথ পদাতিক সৈন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে থাকার ফলে রাষ্ট্র নিরাপত্তা বেশি থাকে-
”যত্ পুরং দুর্গসম্পন্ন ধান্যায়ুধসমন্বিতম্।
দৃঢ়প্রাকারপরিখং হস্ত্যশ্বরথসংকুলম্।।”
আচার্য কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে চার প্রকার দুর্গের উল্লেখ করেছেন। সেই চারটি দুর্গ হল- যথাক্রমে ধন্বদুর্গ, গিরিদুর্গ, অবদুর্গ,বার্ক্ষদুর্গ। কৌটিল্য কথিত এই চারপ্রকার দুর্গের মধ্যে যে কোনো দুর্গই মহীদুর্গ হতে পারে। কারণ প্রতিটি দুর্গই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা থাকে। প্রতিটি দুর্গকে আবার নৃ'দুর্গও বলা হয়। কারণ প্রতিটি দুর্গ রক্ষার জন্য সৈন্য সমাবেশ থাকে। অতএব, আচার্য কৌটিল্য কৃত দুর্গ বিভাগ মনুর থেকে অধিক যুক্তি সঙ্গত।
তাই সেখানেই রাজা দুর্গ নির্মাণ করবে যেখানে প্রয়োজনীয় অস্ত্র-শস্ত্র,ধন-ধান্য, চতুরঙ্গ বাহিনী,মন্ত্রী, পুরোহিত, স্থাপিত নানাপ্রকার লৌহ নির্মিত যন্ত্রপাতি, চতুষ্পদ, জীবের প্রাণ ধারণের সামগ্রীর সুব্যবস্থা থাকবে।এছাড়াও ব্রাহ্মণ থাকবেন। চিকিৎসক ও ঔষধ প্রভৃতি বসবাসের উপযোগী দ্রব্যও থাকবে। দুর্গের মধ্যে অত্যন্ত সুরক্ষিত পরিখা ও প্রাচীর থাকবে। সমস্ত ঋতুতে পুষ্প ও ফলের প্রাচুর্য যুক্ত আরাম দায়ক,সু সজ্জিত, বহুকক্ষবিশিষ্ট উপযুক্ত ধারাগৃহ উদ্যান ও উপবন সমন্বিত স্থানে রাজা নিজের রাজগৃহ নির্মান করবেন।
আচার্য মনু দুর্গ নির্মাণের প্রয়োজনীয়তা উল্লেখ করেছেন। রাজা ও রাজ্য রক্ষায় দুর্গের গুরুত্ব অপরিসীম। সম্মুখ যুদ্ধে একজন ধনুর্ধর একজন যোদ্ধার সাথে করতে পারে। কিন্তু দুর্গে অবস্থিত একজন যোদ্ধা শতসংখ্যক শত্রু যোদ্ধার সাথে যুদ্ধ করতে সক্ষম। কারণ তিনি সুরক্ষিত।আত্মরক্ষার জন্য তাঁর মনোনিবেশের দরকার নেই। অনুরূপভাবে এরূপ দুর্গে আশ্রিত শতসংখ্যক যোদ্ধা শতসহস্র শত্রু যোদ্ধাকে অনায়াসে পরাজিত করতে পারে-
“একঃ শতং যোধয়তি প্রাকারস্থো ধনুর্ধরঃ।
শতং দশ সহস্রাণি তস্মাদ্ দুর্গং বিধীয়তে।।”
অতএব মনুর মতে রাজার পক্ষে দুর্গ নির্মান একান্ত অপরিহার্য। যাজ্ঞবল্ক্য স্মৃতিতে দুর্গ নির্মানের উদ্দেশ্য সম্পর্কে যথার্থভাবেই বলা হয়েছে। রাজার কাছে দুর্গের প্রয়োজন নিজের বাঁচার জন্য, রাজ্যের প্রাণীদের রক্ষার জন্য এবং রাজকোষের জন্য-
‘তত্র দুর্গাণি কুর্বীত জন-কোশাত্মগুপ্তয়ে।’
রাইবনিয়া গড় এই প্রাচীন রীতি মেনেই যে নির্মিত সেক্ষেত্রে আর বলার কোনও অপেক্ষা রাখে না। দুর্গের সমস্ত উৎকৃষ্ট পরম্পরা মেনেই উড়িষ্যার এই গড়টি যে রচিত হয়েছিল তা প্রাথমিক পর্যবেক্ষণেই দৃষ্টি গোচর হবে। হয়তো ভূমিরূপ গিরি দুর্গের অনুকূল না থাকায় সেই বৈশিষ্ট্য তেমন নেই তবে বাকি যে সব উৎকৃষ্ট দুর্গের বর্ণনা আমরা পাই তার অধিকাংশই এই দুর্গে দেখতে পাওয়া যায়।
★রাইবনিয়া গড়★
রায়বানিয়ার দুর্গ (21°55′26.12" N; 87°11'36.83" E) মধ্যযুগীয় চারটি দুর্গের মধ্যে অন্যতম ও বৃহত্তমও। মাটির দুর্গটি উড়িষ্যার বালাসোর জেলার জলেশ্বরের নয় মাইল উত্তরে এবং সুবর্ণরেখা নদীর ডান তীর থেকে দুই মাইল দূরে অবস্থিত। এলাকাটি ছিল তিন দিক থেকে সুবর্ণরেখা নদী দ্বারা বেষ্টিত এবং শুধুমাত্র পশ্চিম দিকটিই বিস্তীর্ণ ও উন্মুক্ত যা ছিল একসময় ঘন জঙ্গলে পরিপূর্ণ। রাইবনিয়া দুর্গটি বেশ বড় এমন কি এই দুর্গ বারাবতীর থেকেও বড় এবং ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ। এই বারাবতী দুর্গ হল একটি 987 খ্রিস্টাব্দের দুর্গ, যা ওড়িশার কটকের সোমবংশী (কেশরি) রাজবংশের মারাকাটা কেশরি দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। দুর্গের ধ্বংসাবশেষ তার পরিখা , গেট এবং নয়তলা প্রাসাদের মাটির ঢিবিসহ রয়ে গেছে।(মহতাব ১৯৫৯)
'জন বিমস' যিনি তৎকালীন বালেশ্বরের ম্যাজিস্ট্রেট এবং একজন প্রত্নতাত্ত্বিক বলে বিবেচিত হতেন তিনিই ঊনবিংশ শতাব্দীতে এলাকাটি জরিপ করেছিলেন এবং দুর্গ সম্পর্কে বর্ণনাও করেছিলেন। যদিও দূর্গের আয়তনের উল্লেখ কোথাও নেই। কোন পাথর বা তামার শিলালিপিও এখনও অবধি আবিষ্কৃত হয়নি। বিমস সাহেব(১৮৭২ খ্রীঃ) সুবর্ণরেখা নদীর দক্ষিণ দিকে চারটি দুর্গের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছিল, যদিও এর মধ্যে দুটি দুর্গ নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত। চারটি দুর্গের মধ্যে দুটি বড় দুর্গ রায়বনিয়া গ্রামের কাছাকাছি এবং ছোট দুটি ফুলতা (ফুলহাট্টা) গ্রামে। এই দুটি ছোট দুর্গের মধ্যে এখন আর কিছুই অবশিষ্ট নেই মাটির দেয়ালের রূপরেখা ছাড়া, লেটেরাইট পাথরের বিক্ষিপ্ত ধ্বংসাবশেষ এবং এইভাবে সম্পূর্ণভাবে ভেঙে ফেলা হয়েছে।
১৮৭২ সালে বিমসের তৈরি নক্সার খসড়াউড়িষ্যার উত্তর-পূর্ব সীমান্তে কৌশলগত অবস্থানের কারণে মধ্যযুগীয় সময়ে বালেশ্বর জেলা উড়িষ্যার ইতিহাসে বিশেষ সামরিক গুরুত্ব অর্জন করেছিল। কলিঙ্গের একটি অংশ হিসাবে, জেলাটি নন্দ, মৌর্য এবং মহামেঘবাহনদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরবর্তী শতাব্দীতে উড়িষ্যার বিভিন্ন প্রধান শাসক ও রাজবংশ যেমন ভঞ্জ, ভৌমকর, সোমবংশী, গঙ্গ এবং গজপতিরা জেলার অঞ্চলগুলিকে তাঁদের রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। গঙ্গ ও গজপতিদের আমলে এই জেলার মধ্য দিয়ে বাংলায় সমস্ত সামরিক অভিযান পরিচালিত হত। মুসলমান শাসকদের নজর এই জেলার উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে নিবদ্ধ হয়। মোগলমারীতে আফগান সেনাবাহিনী এবং মুঘল সৈন্যদের মধ্যে যে তুমুল লড়াই অনুষ্ঠিত হয়েছিল তা আজ তথ্য ও নথির দরুণ প্রমানিত সত্য।(খননকৃত প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ২০০৩ - ০৭ এবং ২০০৮ - ১২)। যা ভৌগোলিক ভাবে সুবর্ণরেখা নদীর তীরে জলেশ্বর শহরের কাছাকাছি। রায়বনিয়া দুর্গটি গঙ্গ রাজবংশের শাসকদের রাজনৈতিক ও সামরিক কর্মকাণ্ডে একটি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে সক্ষম হয়েছিল। চোড়গঙ্গের রাজত্বকাল থেকে গঙ্গরা উড়িষ্যায় প্রায় পনেরো প্রজন্ম ধরে রাজত্ব করেছিল, যা প্রায় প্রায় মোট ৩২৫ বছর। তারা তাদের রাজধানী মুখলিঙ্গম থেকে কটকে (কটক) স্থানান্তর করে, যাকে তাঁরা 'বারাণসী কটক' বলে অভিহিত করতেন। এখানেই তাঁরা স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। এই সময় বেশ কিছু ওড়িয়া পণ্ডিত দেখেন যে উড়িষ্যার গঙ্গরা উড়িয়া রীতিনীতিকে আত্মস্থ করে সমস্ত ব্যবহারিক কাজের উদ্দেশ্যে উড়িয়া ভাষাকে গ্রহণ ও উড়িয়া সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতাও শুরু করেছেন।
খ্রীস্টপূর্ব ষোড়শ শতাব্দীতে আবুল ফজল রচিত--"আইন-ই-আকবরী"তে রাইবনিয়া গড়কে "রায়ন" হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে। উড়িষ্যা সীমান্তের এই স্থানটির অবস্থা দেখে সন্দেহ নেই যে এটিই সেই স্থান যার সঠিক উচ্চারণ হল 'রাইবন' (বিমস 1872)। "আইন-ই-আকবরীতে" তিনটি দুর্গের অস্তিত্বের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। জন বিমস (১৮৭২ খ্রীঃ) যখন এলাকাটি অন্বেষণ করেন তখন 'Rayn'-এ মোট চারটি দুর্গের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। লিখিত নথির অভাবে রাইবনিয়া দুর্গের কোনও নির্দিষ্ট সময় নির্ধারণ করা দুরূহ তবে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে বেশ কয়েকটি পরোক্ষ সূত্রে এই দুর্গের সময় অনুমান করা যেতে পারে--
প্রথমতঃ
একটি কিংবদন্তি অনুসারে রাইবনিয়া ছিল মহাভারতের রাজা বিরাটের রাজধানী, যেখানে পাণ্ডবরা তাদের নির্বাসনের শেষ বছর অর্থাৎ অজ্ঞাত বাসের সময় বনে ছদ্মবেশে লুকিয়েছিলেন। রাজা বিরাটের প্রধান দেবতা ছিলেন কীচকেশ্বরী দেবী বা গড়চণ্ডী বা জয়চণ্ডী যিনি এই দুর্গে পূজিত হতেন। উল্লেখ করা হয়েছে যে ময়ূরভঞ্জের একজন অজানা পরবর্তী রাজা জোরপূর্বক দেবতাকে নিয়ে গিয়ে খিচিংয়ের একটি মন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এইভাবে খিচিং মন্দিরের নির্মাণ হয় দশম বা একাদশ শশতাব্দী নাগাদ, তাহলে রাইবনিয়া দুর্গের প্রাচীনত্ব আরও অনেক আগে বলা যেতেই পারে। কিন্তু যথেষ্ট প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণের অভাবে এটা মেনে নেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক অসংলগ্নতার সম্মুখিন হতে হয়। তাছাড়া মহাভারতের যুগে নির্মিত একটি দুর্গ এত দীর্ঘ সময়ের পরে টিকে থাকার সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে।
দ্বিতীয়তঃ
'বিমস' সাহেব অনুমান করেন, উড়িষ্যার শেষ হিন্দু শাসক 'মুকুন্দদেব' দ্বারা এই দুর্গটি নির্মান করা হয়েছিল। তিনি "বারবতী"র মহান ঐতিহাসিক দুর্গ এবং অসংখ্য জলাধার এবং ঘাট সংস্কারের জন্য খ্যাত ছিলেন (যার অর্থ ভারতের একটি নদীর তীরে বা জলাধারের তীরের দিকে যাওয়ার একটি বিস্তৃত হাঁটাপথ বিশেষত স্নানের জন্য দূরবর্তী সীমান্ত অঞ্চলগুলিতে ব্যবহৃত হত। তবে এই রাজার সংক্ষিপ্ত রাজত্ব কালে একাধিক মুসলিম শাসকের আক্রমণকে রোখার জন্য এত শক্তিশালী দুর্গগুলি নির্মাণে পর্যাপ্ত সময় এবং সংস্থান নিয়ে প্রচুর সন্দেহের অবকাশ ঘনীভূত হয়। তাই গঙ্গ রাজাদের সাম্রাজ্যের সময় এই রাইবনিয়া গড়ের কীর্তির নির্ধারণ করা বেশ খানিকটা যুক্তিসঙ্গত হতে পারে। চোড়গঙ্গদেব, অনঙ্গভীমদেব এবং নরসিংহদেবের মতো বিশিষ্ট শাসকরা নানান স্থাপত্যের জন্য কৃতিত্ব পেয়ে থাকেন। তাছাড়া সময় সময় হানাদারদের সাথে লড়াইয়ের জন্য বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের যশ ও প্রভাব প্রতিষ্টা করতে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছিলেন এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাই যে দুর্গটি মূলত সামরিক উদ্দেশ্যে নির্মিত হয়েছিল, পরবর্তীকালে সাম্রাজ্যবাদী 'গঙ্গ' রাজবংশের পতনের পরেও একাধিক শাসক দ্বারা উক্ত দুর্গের সুফলকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের সামরিক বাহিনীকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে তুলতে পেরেছিলেন।
তৃতীয়তঃ
রাইবানিয়া দুর্গের পুনর্নির্মাণে নরসিংহদেব (১২৭৮ -১৩০৬ খ্রী)
নরসিংহদেব কটক সন্নিকটস্থ রেমুনাতে যখন শিবির স্থাপন করছিলেন সেই সময় দুটি সেট কপার প্লেট জমি অনুদানের জন্য আলালপুর (১২১৫ সাকা) এবং কেন্দুপাটনা (১২১৭ সাকা) (ভাসু ১৮৯৬) জারি করা হয়েছিল। এই কেন্দুপাটনা কপার প্লেটেও তাই রাইবনিয়ায় দুর্গের উল্লেখ পাওয়া যায়। এইচ.কে মহতাব (১৯৫৯) বক্তব্য রেখেছিলেন যে উত্তর সীমান্তে সুরক্ষা ব্যবস্থার তদারকি করার জন্য পুনর্নির্মিত কটক তাই ১১দশ-১২দশ শতকের সময়কালে একটি গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ছিল এবং উড়িষ্যার রাজারা এখানে প্রায়শই শিবির স্থাপন করতেন। তিনি আরও বলেন যে পরবর্তী কালে পুনর্নির্মাণের মাধ্যমে রেভানা এবং তারপরে তাকে রায়ভানিয়া বলা হত। তবে এই বিবৃতিগুলি দ্বিতীয় নরসিংহদেবের রাজত্বকালে রায়বনিয়ার দুর্গটি নির্মাণের সম্ভাবনার দিকে সরাসরি ইঙ্গিত করে না। এসি.সি. পাত্র বলেন যে দ্বিতীয় রাজা নরসিংদেব দুর্গটি নির্মানের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেননি কারণ তাঁর এবং বাংলার আফগান শাসকদের মধ্যে কয়েকটি ছোটখাটো দ্বন্দ্ব ব্যতীত কোনও বড় যুদ্ধ সে ভাবে সংঘটিত হয়নি। এই সমস্ত ঘটনা স্পষ্টভাবে প্রকাশ করে যে রাইবনিয়া দুর্গটি বিখ্যাত ছিল যখন তিনি ১২৭৮ খ্রীঃ -তে সিংহাসনে আরোহণ করেছিলেন।
চতুর্থতঃ
এই দুর্গের উল্লিখিত তথ্যের পটভূমিতে নরসিংহদেব(১ম) (১২৩৮-১২৬৪ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক রায়বনিয়ায় দুর্গ নির্মাণের বিষয়ে একটি চতুর্থ সম্ভাবনাও উল্লেখ করা যেতে পারে। সুতরাং সেই সময়ের পরিস্থিতি এবং সামরিক বাধ্যবাধকতাগুলি বিবেচনা করা অত্যন্ত প্রয়োজন যার কারণে রাজা সেখানে এত বিশাল এবং অজেয় দুর্গ নির্মাণ করেছিলেন। প্রথম নরসিংহদেব বাংলার কিছু অংশ উড়িষ্যায় তার সাম্রাজ্যের সাথে যুক্ত করেন যা মুসলিম শাসকদের দখলে ছিল। সেই সব স্থান নিজের অধীনে নিয়ে আসতে তিনি নিজেও মুসলিম শাসকদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা গ্রহণ করেন এবং একাধিকবার বাংলা আক্রমণ করেন। এইভাবে তিনি তুগরল তুগান খানের সাথে (তুগরল তুগান খান (ফার্সি: طغرل طوغان خان), দিল্লি সালতানাতের মামলুক রাজবংশের একজন কর্মকর্তা ছিলেন। তিনি ১২৩২ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিহারের এবং ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার (লখনৌতি) গভর্নর ছিলেন।) এবং পরবর্তীতে দিল্লি সাম্রাজ্যের শাসকদের অধীনে বাংলার গভর্নর মালিক ইখতিয়ারউদ্দিন উজবাকের সাথে(১২৫১ খ্রী থেকে ১২৫৫ খ্রীস্টাব্দ পর্যন্ত বাংলার দিল্লি সাম্রাজ্যর গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। পরে তিনি ১২৫৫খ্রী থেকে ১২৫৭খ্রী পর্যন্ত উত্তরবঙ্গের একজন স্বাধীন সুলতান হিসেবে রাজত্ব করতেন।) সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েন। উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণের জেলাগুলি - মেদিনীপুর, হাওড়া এবং হুগলিকে উড়িষ্যা রাজ্যের সাথে সংযুক্ত করা। (দাস ১৯৩৫, ১৯৮৬; মহতাব ১৯৫৯)।
★দুর্গ প্রাচীর এবং প্রবেশদ্বার★
দুর্গটি একটি অনিয়মিত পেন্টাগনের আকারে রয়েছে যার নিচের ডাইমেনসনে রয়েছে- পূর্ব প্রাচীর-৪৯৫০ফুট; উত্তর প্রাচীর - ৪৯৫০ফুট; উত্তর-পূর্ব প্রাচীর ২৬৪০ফুট; দক্ষিণ-পশ্চিম প্রাচীর ৪৬৫০ফুট এবং দক্ষিণ প্রাচীর ২৬৪০ফুট। দুর্গের প্রাচীরগুলি পাথরের বড় থেকে ছোট ক্রমান্বয়ে স্তরগুলি নিয়ে গঠিত যা ধীরে ধীরে একটি নির্দিষ্ট বিন্দুতে ছোট হয়ে আসে। সম্পূর্ণরূপে মাটির তলায় ঢেকে থাকা ভিত্তিটির প্রস্থ ১১২ফুট এবং উচ্চতা ৫০ ফুট (দাস-১৯৮৬)। তবে বর্তমানে প্রাচীরের উচ্চতা মাত্র ২০ফুটেরর বেশি নয়। হয়তো জমির স্তর উঁচু হয়ে যাওয়াই এর প্রধান কারণ।
(১)পূর্ব দিকের দুর্গের তিনটি প্রবেশপথ বা প্রবেশপথ ছিল ঘুন্টদ্বারঅ/ঘন্টাদ্বার বা সিংহদ্বার।
(২)পশ্চিমে ছিল হাতিদ্বার/হাথী বাঁধদ্বার;
(৩)দক্ষিণে ছিল সুনামুখিদ্বার, যা বর্তমানে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে।(তবে উড়িষ্যা সরকার একটা প্রকল্পের মাধ্যমে তা পুনর্নির্মাণ করছেন)
(৪) দুর্গের উত্তর দিকে ঘন কাঁটাবাঁশ-বনে ঢাকা। গেটওয়েগুলি বড় ল্যাটেরাইট ব্লক বা মাকড়া পাথরের চাঁই দিয়ে নির্মিত। দুর্গ প্রাচীরটির চারদিকে বেশ কয়েকটি গ্রামের সীমানা ছুঁয়ে যায়- জামিরাপাল, চুড়ামণিপুর, উলমারা, গোপাল-প্রসাদ, আড়িয়া-শাহী, হাতীগড় ও রায়বনিয়ার সন্নিকটস্থ সুবর্ণরেখা নদীর তীর। দুটি দুর্গ প্রাচীরের মধ্যে পরের প্রাচীরের কাছাকাছি একটি সুগভীর পরিখার প্রমাণ আজও দৃশ্যমান(যদিও আজ গভীরতা মরে গিয়ে চাষের জমিতে রূপান্তরিত হয়েছে)। বর্তমানে পূর্ব দ্বার রাইবনিয়া ও ওলমারা গ্রামের সমীপে দাঁড়িয়ে আছে উঁচু প্রাচীরের অবশিষ্টাংশ।
এই দুটি দুর্গ প্রাচীর অতিক্রম করলে অন্য দুটির মতো প্রবেশপথ সহ আরেকটি প্রাচীর পাওয়া যায় এবং দ্বিতীয় ও তৃতীয় দেয়ালের মাঝখানে আরেকটি পরিখা পাওয়া যায়। এই প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থাটি পরপর তিনটি দুর্গ প্রাচীরের অস্তিত্ব আঁকড়ে ইতিহাস বহন করে চলেছে।
দুর্গের চারপাশ সমগ্র পূর্ব ভারতে এটিকে স্থাপত্যের দিক থেকে বেশ অনন্য করে তুলেছে। কিছু দুর্গে ডাবল পরিখা পদ্ধতির উপস্থিতির উদাহরণ রয়েছে, তবে তিনটি- দক্ষ প্রশাসন এবং বিদেশী আগ্রাসকদের সাথে সফল লড়াইয়ের জন্য বিভিন্ন অঞ্চলে বেশ কয়েকটি কটক (সংস্কৃত থেকে প্রাপ্ত যার অর্থ সামরিক ভিত্তি বা স্থাপনাকে ঈঙ্গিত করে)। মূলত সামরিক উদ্দেশ্যে নির্মিত দুর্গটি পরবর্তীকালে উড়িষ্যা সাম্রাজ্যের গঙ্গ রাজবংশের পতনের পরেও একাধিক শাসকের দ্বারা আরও দৃঢ় এ মজবুত করা হয়েছিল এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। রাইবনিয়া দুর্গটির প্রাচীরের বৈশিষ্ট্য প্রমাণিত যা ভারতে একটি প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় দুর্গ এবং দুর্গের ইতিহাসে অতুলনীয়।
★আনুমানিক প্রাসাদ কাঠামো★
দুর্গ বর্ণনার পাশাপাশি জন বিমসের নথিতে সুরক্ষিত এলাকার অভ্যন্তরে আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কাঠামোর উল্লেখ রয়েছে। তবে গ্রামবাসীদের দ্বারা চাষের জন্য বেশিরভাগ অংশ সমতল করা এবং সংরক্ষণের অভাবে, প্রাথমিক জরিপে এই কাঠামোর অবশিষ্টাংশগুলি চিহ্নিত করা যায়নি। সবচেয়ে বড় এবং সবচেয়ে সুস্পষ্ট ভবনটি ছিল সাত গম্ভীরা অট্টালিকা, যাকে দুর্গের অভ্যন্তরে প্রাসাদ বা রাজকীয় বাসস্থান বলে মনে করা হয়। এছাড়াও, অন্যান্য ছোট প্রাসাদ বা সরকারী ভবন এবং বিভিন্ন দেব-দেবীকে উৎসর্গ করা মন্দির ছিল। ড্রেসড ল্যাটেরাইট পাথরের বড় ব্লক অবশ্যই এই ভবনগুলির নির্মাণে ব্যবহার করা হয়েছিল বলেই অনুমান কারণ এর মধ্যে বেশ কয়েকটি ঐরূপ পাথর ইতস্তত এলাকার চারপাশে ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় পাওয়া যায়। জয়চণ্ডী মন্দিরে ঢোকার প্রবেশ পথের সম্মুখে এই ধরনের দু একটি পাথরের চাঁই লক্ষ্য করা যায়।
★জয়চণ্ডী মন্দির-চত্তর★
মন্দির চত্তরটি ১৯৭৯ সালে এ.এস.আই(Archaeological Survey of India) দ্বারা আংশিক ভাবে কিয়দাংশ পরিষ্কার এবং পুনরুদ্ধার করার চেষ্টা করা হয়েছিল। আজ থেকে ১৭-১৮ বছর আগেও মন্দিরের ভেতরে গাছপালার বৃদ্ধি পুরো মন্দির কমপ্লেক্সটি অন্বেষণ এবং স্কেচ পরিকল্পনা তৈরি করার ক্ষেত্রেও বেশ কঠিন ছিল।
এই কাঠামোটি প্রথমে বিমস তার প্রতিবেদনে একটি প্রাসাদ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন, কিন্তু পরে তিনি নিজেই এটিকে একটি শিব মন্দির হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন।
অসুবিধা সত্ত্বেও মন্দিরের গতিবিধি যতদূর সম্ভব পরিমাপ করা হয়েছে এবং মন্দিরের একটি মোটামুটি স্কেচ পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া এলাকার বিভিন্ন উপাদানের পরিমাপও নেওয়া হয়েছে। স্থানীয় বিশ্বাস অনুসারে মন্দিরটি ভগবান জগন্নাথকে উৎসর্গ করা হয়েছিল। যাইহোক, বর্তমান জরিপ প্রকাশ করে যে সমস্ত সম্ভাবনায় মন্দিরের প্রধান দেবতা শিব। গর্ভগৃহ বা গর্ভগৃহ থেকে দেবতার উপর অতিরিক্ত জল ঢালার জন্য একটি চ্যানেলের উপস্থিতি দ্বারা এর প্রমাণ পাওয়া যায়। শিবলিঙ্গে জল বা দুধ ঢালা ভক্তদের দ্বারা অনুসরণ করা একটি সাধারণ রীতি।
তাই এটি শিব মন্দিরগুলির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সব শিব মন্দিরেই এই ধরনের বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়। বর্তমান প্রাথমিক জরিপ থেকে জানা যায় যে মন্দিরটি ৫৭x৪৯ বর্গ মিটার পরিমাপের একটি বড় আয়তক্ষেত্রাকার এলাকায় অবস্থিত এবং বাইরের দেয়ালগুলি মূলত চুন দিয়ে প্লাস্টার করা হয়েছে বলে মনে হয়। আয়তক্ষেত্রাকার ঘেরের ভিতরে, মন্দিরটি মাটির স্তর থেকে ৫ফুট উপরে একটি চূড়ায় উত্থিত হয়েছিল। রেখ-দেউল টাইপ মন্দিরের অনুরূপ ত্রাণে ক্ষুদ্র ভাস্কর্য দিয়ে প্লিন্থটি সজ্জিত ছিল যা এমনকি সাধারণ আমলাকা শিলা দ্বারা চূড়াটি নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি ৪২.৬x১১.৮ বর্গ মিটার পরিমাপের আয়তাকার এবং উভয় পাশে দুটি রথের মতো আদল রয়েছে। মন্দির চত্তরের পূর্ব দিকে একটি কূপ রয়েছে যা সুড়ঙ্গেরর মত, যার নীচে নামার জন্য একটি পাথরের তৈরির সিড়ির ধাপও রয়েছে। প্রবেশদ্বারের কাছে অত্যধিক গাছপালা বৃদ্ধির কারণে, কূপটি সঠিকভাবে চিত্রিত এবং পরিমাপ করা যায়নি
এই বৃহৎ মন্দির-চত্তরের দক্ষিণ প্রাচীরের বাইরে দেবী জয়চণ্ডীর একটি ছোট মন্দির রয়েছে, যা বর্তমানে স্থানীয়রা উপাসনা করে। যেহেতু মূর্তির গোড়াটি ভেঙে গেছে তাতে প্রতিমাটিতে লাল শাড়ি পরিয়ে একটি তির্যক অবস্থানে রাখা হয়েছে। মূতিটি পুরোপুরি সিঁদুর দিয়ে রঞ্জিত তাই ভাস্কর্যের আইকনোগ্রাফিক বৈশিষ্ট্যগুলির যথাযথ বিবরণ নির্ধারণ করা কঠিন।
ভাস্কর্যটিকে কেউ কেউ চামুন্ডা বা মহিষাসুরমর্দিনী হিসাবে বর্ণনা করেন।
★দুর্গের ভিতরের জলাধার★
দুর্গের অভ্যন্তরে বিভিন্ন আকারের অসংখ্য জলাধার, বাঁধ বা দিঘি নির্মাণ করা হয়েছিল, সম্ভবত সৈন্যদের সাথে সাথে তাদের অশ্ব, গবাদি পশুদের জন্যে শিবিরগুলি এই জলাধারগুলির কাছাকাছি স্থাপন করা হয়েছিল যাতে তাদের পোষ্যদের যথাযথ জল সরবরাহ করতে পারে। ডঃ এইচ.সি দাস ১৯৮৬ সালে (দাস 1986) ছাব্বিশটি জলাধার চিহ্নিত করেছিলেন এবং তাদের নামও উল্লেখ করেছিলেন। এগুলি হল--নন্দিকা, দেউলা, ভূঞ্যা, সিরসা, হীরারানী, কৌশল্যা, বাজারঘন্টা, বীরা, সিয়াঁড়া, মঙ্গরাজা, ঢেঁকিপাড়া, গন্ডাগুড়া, মাথা কৌমারী, পান্ডাসরো, মহিসী, গড়খাই (কালিয়াদহন), ধনুফাটা, টেঁঢ়াগাইড়্যা, শিলাপাতা, পল্লববেহারাগাইড়্যা, বালিপাকা পোখরি, ধানগাড়হা, চিড়াকুন্ড, নেতাকুন্ড এবং জলযন্ত্র পোখারি ইত্যাদি
★★
বেশিরভাগ জলাধারগুলির নাম যাঁরা খনন করেছেন অথবা যাদেরকে উৎসর্গ করে খনন করা হয়েছে সেগুলিকেই বোঝায়। বেশির ভাগ
সেনা জেনারেলদের দ্বারা খনন করা অথবা কিছু রানী এবং রাজকুমারীদের উৎসর্গ করা হয়েছে বলে মনে হয়। কিছু জলাধারের সাথে কিংবদন্তিও জড়িয়ে রয়েছে এবং সেটা খুবই স্বাভাবিক। জলযন্ত্র পোখারি মূল দুর্গের বাইরে উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত কিন্তু সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে এটির ভিতরে একটি গোপন কুঠুরি রয়েছে বলে ধারণা করা হয় যেখানে সৈন্যরা তাদের যুদ্ধে ব্যবহৃত অস্ত্র লুকিয়ে রাখত বলে কথিত আছে। তবে বর্তমানে জলাধারের সামনে গিয়েও তেমন কোনও কুঠরির খোঁজ পাইনি। তবে স্থানটি বর্তমানে কাঁটা বাঁশের ঝাড়ে পরিপূর্ণ। অত্যন্ত সাবধানে চলাফেরা করতে হয় নাহলে পদে পদে বাধা পাওয়াটা স্বাভাবিক বিষয়।
★জোড়া হাইল্যা কুঁয়া★
বর্তমানে রাজবাঁধ থেকে জলেশ্বের দিকে যাওয়ার বড় রাস্তার ঠিক ডান দিকে অর্থাৎ রায়বনিয়া-কপাটঘাটি রাস্তার পশ্চিম দিকে সুরক্ষিত এলাকার মধ্যে প্রায় ৮.৫ মিটার ব্যাসের বিশাল একটি কূপ যার ধাপগুলি একটি বৃত্তাকার পদ্ধতিতে(spirally) সাজানো রয়েছে যা দুটি বলদ একসঙ্গে জোয়ালে বাঁধা অবস্থায় জল খেতে নামতে পারে। কূপটির কাছের একটি ঝরনা থেকে নাকি জল নিঃসরিত হত। কিন্তু বর্তমানে তা ৬-৭ফুট গভীরতা নিয়ে বেঁচে আছে, বাকি সবটাই মজে গ্যাছে। কূপ নির্মাণের জন্য ল্যাটেরাইট ব্লককে কেটে কেটে পাথরের সিঁড়িগুলি তৈরি করা হয়েছে। এবং গোটা কুঁয়াটাই পাথর কেটে তৈরি।
★দুমদুমি ব্রিজ★
এই সেতুটি বিমস দ্বারা উল্লেখ করা হয়নি। সেতুটির প্রাচীনত্ব সম্ভবত দুর্গের সময়কালের। সেতু নির্মাণে ব্যবহৃত ল্যাটেরাইট ব্লকগুলিকে ধরে রাখার জন্য লোহার ক্ল্যাম্পের ব্যবহার থেকে এটি স্পষ্ট হয়। 1295-1303 খ্রিস্টাব্দে রেমুনায় থাকার সময় জারি করা নরসিংহদেব দ্বিতীয়ের তাম্রলিপিতে উল্লেখ করা হয়েছে যে গঙ্গ রাজবংশের রাজাদের রাজত্বকালে সুবর্ণরেখার উপর একটি সেতু বিদ্যমান ছিল। দুর্গের মধ্য দিয়ে যাওয়া একটি পরিখার উপর নির্মিত একটি প্রাচীন সেতু, ২০ বছর আগেও এর ধ্বংসাবশেষ ছিল কিন্তু বর্তমানে তার সবই নিশ্চিহ্ন।
নরসিংহ মূর্তি/ নন্দী মূর্তি
রাইবনিয়া গড় কৌশলগত ভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থিত। সুবর্ণরেখা নদী তিন দিকে একটি প্রাকৃতিক বাধা তৈরি করে এবং চতুর্থ পাশ বাঁশের ঘন ঝোপ এবং অন্যান্য কাঁটাযুক্ত ঝোপ দ্বারা সুরক্ষিত। রায়বনিয়া দুর্গের গুরুত্ব তার স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য থেকে বেশ স্পষ্ট, যা এই দুর্গের অনন্যতা প্রমান করে। ত্রিভুজাকার ক্রস-সেকশনে কাদা দ্বারা আবৃত পিরামিডিক্যাল কঙ্কাল তৈরি করে ল্যাটারাইট ব্লক ব্যবহার করে দেয়াল নির্মাণের কৌশলটি বেশ ভিন্ন। পরপর তিনটি বিশাল দুর্গ প্রাচীরের উপস্থিতি ছাড়াও, প্রতিটি পরিখা দ্বারা বিভক্ত করা এবং প্রবেশদ্বারগুলি সমগ্র পূর্ব ভারতে এই দুর্গের জন্য অবশ্যই অদ্ভুত। এইভাবে রায়বনিয়া দুর্গের ব্যাপক নির্মাণ ও বিস্তারের সাথে এই বৈশিষ্ট্যগুলি এই দুর্গকে দেওয়া বিশ্বাসের কথা ঘোষণা করে। এইভাবে এটি খুব স্পষ্ট যে এই দুর্গটি তার কৌশলগত অবস্থানের জন্য মূল্যবান ছিল এবং অবশ্যই গঙ্গা রাজবংশের উড়িষ্যা সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষা ও প্রতিরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। উড়িষ্যার সামরিক শক্তি সে সময় পূর্ব ভারতের শীর্ষে ছিল। মুসলিম শাসকরা সীমান্তে বারবার আক্রমণ সত্ত্বেও শক্তিশালী সেনা ব্যারিকেড ভেদ করতে পারেনি। গঙ্গদের কর্তৃত্বের অধীনে রাইবনিয়ার ভূমিকা তাই বহিরাগত আক্রমণ প্রতিরোধে কৌশলগত অবস্থানের দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল শুধু তাই নয় সেনাবাহিনীকে তাদের মহড়ার জন্য ছাউনি ও আশ্রয়ও প্রদান করেছিল।
উড়িষ্যার বালেশ্বর জেলার রাইবনিয়া গড়টি মধ্যযুগীয় দুর্গের কাঠামোগত অবশেষগুলির অধ্যয়নের সাথে সম্পর্কিত। দুর্গটি খুব সুসজ্জিত ভাবে একসাথে রাখা পাথরের তৈরি। তিনটি প্রাচীরের দুর্গটি পরপর দুটি পরিখা দ্বারা বিভক্ত, একটি বৈশিষ্ট্য রাইবনিয়ায় প্রমাণিত, যা ভারতের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় দুর্গ এবং দুর্গের ইতিহাসে অতুলনীয়। জয়চণ্ডী মন্দির চত্তরের, একটি বিশাল কূপ, অসংখ্য জলাধার এবং একটি প্রাচীন সেতুর অবশিষ্টাংশের(যদিও এখন তা এক রকমের নিশ্চিহ্নই) মতো আরও বেশ কিছু স্থাপত্য সমগ্র পূর্বাঞ্চলের দুর্গের স্বতন্ত্রতাকে বাড়িয়ে তোলে।
★কয়েকটি প্রসঙ্গিক চিত্রঃ★