দোলগ্রামের কথকতা

দোলগ্রামের ইতিহাস, নয়াগ্রামের ইতিহাস, Nayagramer itihaas, dolgraam, চন্দ্ররেখা গড়ের ইতিহাস,

 




প্রাককথন

উড়িষ্যার সীমানা ছুঁয়ে যে কয়েকটা গ্রাম- জনপদ আজও নিজ নিজ কীর্তিতে সমুজ্জ্বল তার মধ্যে নয়াগ্রাম থানার দোলগ্রাম অন্যতম। এই ছোট্ট গ্রামটি তার প্রাচীনত্ব আঁকড়ে চির ন্যস্টালজিক। দোলগ্রাম নিয়ে টুকিটাকি অনেক কাজই হয়েছে ঠিকই তবে তা সে ভাবে কহতব্য নয়। এর ইতিহাসের শেকড় অনেক গভীরে। চুটিয়া নাগপুরের জঙ্গলাকীর্ণ অন্যান্য বহু গ্রামের মতই এটিও জৈন্য সম্প্রদায়ের অভ্যুত্থানের সময় থেকেই তার ইতিহাস গড়তে শুরু করেছিল। কালক্রমে সেই ইতিহাস অন্যান্য বহুস্থানের মতই রূপ পরিবর্তন করে নতুন ভাবধারায় রঞ্জিত হয়েছে ঠিকই কিন্তু বিগত কালের ছাপ ছেড়ে ছেড়ে সময়ের পরত বোঝাতে আজও অতুলনীয়। 

        এই খাড়াল অঞ্চল যে এক সময় বর্ধিষ্ণু জনপদ ছিল এতে কারুর দ্বিমত নেই। আর এই সাবেকিআনা গড়ে উঠেছিল মূলত সুবর্ণরেখাকে কেন্দ্র করে। জলপথের যে রমরমা সময় তা আজ অনেককালই আর নেই বিশেষত আফগান, তুর্কি ও মোগল আমলের সূচনা পর্ব থেকেই। এই নদীপথই ছিল বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার অন্যতম প্রানকেন্দ্র। কারণ এর মাধ্যমেই যোগাযোগ হত তৎকালিন তাম্বলিপ্পর(তাম্রলিপ্ত) সাথে। এই তাম্বলিপ্প(তাম্রলিপ্ত) সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। কমবেশি সমস্ত ইতিহাস প্রেমী মানুষই জানেন। এখনের সুবর্ণরেখার রূপের সাথে তখনের সুবর্ণরেখার ছিল বিস্তর ফারাক। গতিপথও ছিল ভিন্ন এবং বিস্তৃত। দুই তীরেই বানিজ্যকেন্দ্র ও বৈশ্যদের জান-মালের দায়িত্বও নিয়েছিলেন উড়িষ্য ও তৎসংলগ্ন ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজারা। দুই তীর জুড়েই তাই তৈরি হয়েছিল বানিজ্য সহায়ক ও হেফাজতি দুর্গ। সব যে বাণিজ্যের জন্য দুর্গ তা নয় তবে একপাড়ে কুড়ুমবেড়া ও অন্যপাড়ে রাইবনিয়া গড় ছিল তেমনই কিছু উড়িষ্যারাজকীর্তির নিদর্শন। পরবর্তীকালে অবশ্য দুটোই তার রূপ পাল্টে নেয়। কারণ আরও কিছু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাণিজ্য সহায়ক দুর্গ গড়ে ওঠে। সম্ভবত এই দোলগ্রামও তেমনই একটি দুর্গ। সেই সময় এই জল ও জঙ্গলাকীর্ণ জনপদ ছিল করাল দস্যুদের অবাধ বিচরণ ভূমিও। পিঁপড়ে সেখানেই বিচরণ করে যেখানে গুড়ের সমাহার হয়। এই অঞ্চলটিও তাই। এই অঞ্চলের মুল ভূমিপুত্র ছিল শবর-লোধা ও কুড়মিরা। এর প্রমান সুবর্ণরে নদীর নামোৎপত্তি। পূর্বে যার নামছিল শবরনেখা কালক্রমে তা ইন্দো-ইউরোপীয়ান ভাষা গোষ্ঠীর সংস্পর্শে এসে হয়ে ওঠে সুবর্ণরেখা। আর কুড়মিদের সপক্ষে যুক্তি ইতিপূর্বে রিসলের গেজেটিয়ারের খেলাড়গড়ের প্রতিষ্টাতাদের কথা উল্লেখ করেছি যা কুড়মি ছিল। অতএব আমরা এবিষয়ে নিঃসন্দেহ।


     দোলগ্রাম নাকি দেউলগ্রাম


এই গ্রামটির পূর্বের নাম খুব সম্ভব দেউলগাঁ থেকে থাকতে পারে। আর যেহেতু এই গ্রামটিও জৈন তীর্থঙ্করদের একসময়ের সাধন ভূমি ছিল তাই অন্যান্য সেই সব বহু গ্রামের সামনে বা অন্তে দেউল শব্দটি আজও রয়েছে তাই অনুমান করতে অসুবিধা হয় না যে প্রাচীনে এর নাম দেউল গাঁ-ই ছিল। এই গ্রামের মধ্যেই যে 'নাগাঢিবিটি' রয়েছে তা জৈনদের দিগম্বর রূপকেই নির্দেশ করে। এমন কি যে দীর্ঘ গড় নিদর্শনের চিহ্ন নজরে আসে তাতেও জৈন পরম্পরার শৈলি স্পষ্ট। হতে পারে পরবর্তীকালে এই রাজা চন্দ্রকেতু সেই বর্ধিষ্ণু জনপদকে নিজের বিশেষ কোনও কাজে ব্যবহার করে থাকতে পারেন। এমনও হতে পারে সুরক্ষিত বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে সুবর্ণরেখার এই কুলকে সচল, সচ্ছল ও বণিকদের সুরক্ষা রক্ষা রাখতেই এই গড়ের নির্মাণ, সাথে প্রমোদোদ্যানও। আসলে এই গ্রামটি বিশেষ ভাবে নজর কাড়বে কারণ তার পুরাতাত্বিক নিদর্শন। এই নিদর্শনগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল নাগা ঢিপি, গড়প্রাচীর, গড়কুঁয়া, পক্ষীরাজ মূর্তি, পদ্মপুকুর, জগন্নাথ-দধিবামন মন্দির, Submission দোলমঞ্চ/রাসমঞ্চ, পাশাপাথর,   শিবমন্দির, পুরাণপ্রসিদ্ধ ভাগবত মন্দির প্রভৃতি। এ ধরনের ঐতিহাসিক স্থাপত্যের এই দোলগ্রাম নিঃসন্দেহে এক সংরক্ষণ যোগ্য সমৃদ্ধ গ্রাম বা হেরিটেজ ভিলেজ। দুর্গটি কত সালে কে নির্মাণ করেছিলেন তা নিয়ে অদ্যাবধি গবেষকগণ নিরন্তর গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন। 

      তবে এই দোলগ্রাম সম্পর্কেও বহু মত/ লোকশ্রুতি আজও আনাচে কানাচে কান পাতলে শোনা যায়ঃ

(১নং মত) 

নয়াগ্রাম রাজপরিবারে দুর্গাপুজার জন্য উড়িষ্যার জাজপুর থেকে খোশলনাথ কর নামক জনৈক পুরোহিতকে এনে পৌরোহিত্য করানো হয়, পরে অবশ্য তৎকালিন নায়েবের পরামর্শে তিনিই এই দোলগ্রামের নিত্যপূজার দায়ভার গ্রহন করেন এবং তাকেই দোলগ্রামে স্থায়ী বাসস্থান বানিয়ে দিয়ে সেখানে বসবাসের অনুমি দেওয়া হয়।

     এই মতটি নিতান্তই অর্বাচীন বলেই মনে হয় কারণ নয়াগ্রাম রাজবাড়ির অস্তিত্ব সপ্তদশ শতকের শেষ ভাগ নাগাদ কিন্তু দোলগাঁর নিদর্শন তারও আগের। তাছাড়া বাংলায় দুর্গাপুজার প্রচলন শুরুই হয় ১৫১০ সালে। কুচ বংশের রাজা বিশ্ব সিংহ কুচবিহারে দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিলেন। ১৬১০ সালে কলকাতার বরিশার রায় চৌধুরী পরিবার প্রথম দূর্গা পূজার আয়োজন করেছিল বলে ধারণা করা হয়। তবে পলাশী যুদ্ধের পরে রাজা নবকৃষ্ণের হাত ধরে নতুন রূপে দুর্গাপুজা চালু হয়, তাও আবার লর্ড ক্লাইভের সম্মানে এক প্রকারের বিজয়োৎসব হিসেবে। তাই এই মত দোলগ্রামের ইতিহাসের একটা অংশ হতে পারে কিন্তু মূল নয়।

(২নং মত)

 বহু গবেষকের মত - রাইবনিয়া গড় নির্মাতা শেষ রাজা নরসিংহদেব কর্তৃক এই দোলগ্রাম গড়টিও পরবর্তী সময়েই নির্মিত হয়েছিল। সমসাময়িক সময়েই উড়িষ্যা রাজ কপিলেন্দ্রের ইচ্ছায় নির্মিত হয়েছিল(১৪৩৫-১৪৭০খ্রী) কুড়ুমবেড়া দুর্গটি। যদিও তারাপদবাবুর মতে এটি একটি দেবালয়। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালো রাইবনিয়া গড় থেকে দোলগ্রামের দুরত্ব তিন-সাড়ে তিন কি.মি মত।

     এই মতটির গ্রহণযোগ্যতা অনেকাংশে থাকলেও সময়কাল, নির্মাণ উপাদান ও শৈলি অনেকাংশেই ভিন্ন তাই দ্বিমত তো থেকেই যায়। তাছাড়া পরম্পরাগত লোকশ্রুতিতেও রাজা নরসিংহদেবেরর নাম সে ভাবে কথিত নেই বললেই চলে।

(৩নং মত) 

তারচেয়ে বরং দ্বিতীয় জনশ্রুতির সাথে ঐতিহাসিক কাল নির্মাণ কৌশল এবং উপাদানের অনেক মিল স্পষ্টত দৃষ্টিগ্রাহ্য হয়। লোকশ্রুতিটি এইরূপ-- দোলগ্রামের পাশেই রয়েছে আরও একটি গড়ের ধ্বংসাবশেষ, নাম- চন্দ্ররেখা গড়। রাজা চন্দ্রকেতুর নামানুসারে নাকি এই গড়টির নামকরণ হয়। এই চন্দ্রকেতুই সুস্তনি নামক গ্রামে একটি সহস্রলিঙ্গ শিবমন্দির স্থাপন করেন।(যদিও এই ধরনের শিবলিঙ্গ জৈন্ তীর্থঙ্করদের শ্রদ্ধার নিদর্শন হিসেবে পূর্বে ব্যবহার হত, এই ধরনের লিঙ্গ ঝাড়খণ্ডের ইটুরির সহস্র লিঙ্গে অনুরূপ। যা আসলে সহসূত্রকূট জিনায়া [১০০৮ জৈন মূর্তির মন্দির])। এই রাজা চন্দ্রকেতুই তাঁর প্রমোদদুর্গ হিসেবে বানিয়ে ছিলেন এই দোলগ্রাম গড়টিও। তিনি উড়িষ্যার রাজা হরিচন্দন মুকুন্দদেবকে(১৫৬০-৬৮খ্রী) দোলের দিন বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানাতেন পাশা খেলার জন্য। এখানে ৩ফুট/৫ফুটের একটি পাশা খেলার ছক সহ পাথর আজও দেখতে পাওয়া যায়। রাজা চন্দ্রকেতু ছিলেন হরিচন্দন মুকুন্দদেবের সুুহৃদ ও বন্ধুসম।

(৪নং মত)

কিছু জনের কথায় আবার দোলগ্রাম সম্পূর্ণ পৃথক একটি জমিদারী ছিল। এর সাথে বাকি কোনও রাজা বা রাজ্যের অবদান নেই। তবে এই দোলগ্রামের জনৈক রাজা বৃষকেতু এই গড়টি নির্মাণ করেন। বৃষকেতু ছিলেন অত্যন্ত প্রমোদ বিলাসী সহৃদয় ব্যক্তি। তিনি তাঁর পার্শ্ববর্তী রাজা চন্দ্রকেতুকে দোলের দিন বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানাতেন পাশা খেলার জন্য। 

    যদিও এই বৃষকেতুর উল্লেখ বা প্রামান্য কোনটাই নেই। এমনকি দোলগ্রামের মানুষের মুখেও কখনও এই কাহিনী সে ভাবে কেউ শোনেনি। 

     তাই সবদিক বিবেচনা করলে ৩ নম্বর মতটি সবচেয়ে বেশি গ্রহণযোগ্য এবং প্রামান্য নির্ভরও। এবার আসা যাক দোলগ্রাম ও তার স্থাপত্য নিদর্শনে।

(৫নং মত)

পরিশেষে আরও একটি জনশ্রুতিও ইতস্তত কান পাতলে কখনও সখনও শোনা যায় যে এই দোলগ্রাম চন্দ্রকেতু দ্বারাই নির্মিত হয়। আর এই চন্দ্রকেতু ছিলেন কুড়মি রাজা তাই উৎপন্ন শস্যাদি অতি সুরক্ষিত রাখার জন্য এবং করের আদায়কৃত ধান্য-শস্য-গো-সম্পদ সংরক্ষণের জন্য এই গড়টি উপযোগী ছিল। শুধু তাই নয় এখান থেকেই অন্যত্র দ্রব্য রপ্তানি করা হত। কুড়মিদের যে অংশে উৎপাদিত শস্য মজুত করে রাখা হয় তাকে "ডোল" বলা হয়। আর সেই ডোল শব্দ থেকেই গ্রামটির নামকরণ হয় ডোলগাঁ, পরে তাও পরিবর্তিত হয়ে নাম হয় দোলগ্রাম।



মাননীয় রিজলে সাহেব ও তরুণদেব ভট্টাচার্যের উক্তি দুটি যদি পাশাপাশি রাখি তাহলে ওপরের মতটি যে একদম অমূলক এমনটা বলা নিতান্তই বালখিল্যতার পরিচয় দেওয়া হবে। তাই সত্যাসত্য বিচার আপনারই করুন, আমি তো বাঁশিওয়ালা। খেলাড় গড় যে রাজবংশ তৈরি করছে সেই রাজবংশেরই ৩-য় রাজা চন্দ্রকেতু চন্দ্ররেখা গড় তৈরি করেন আবার তাঁরাই পরবর্তী কালে নয়াগ্রাম রাজবাড়ির প্রভু। সমান্তরাল ভাবে এই দোলগ্রামের পক্ষীরাজ গড় তৈরি করছেন সেই চন্দ্রকেতু। কাজেই ডোলগ্রাম/দোলগ্রাম যে কুড়মি ভাবাদর্শে তৈরি হবে এটাই স্বাভাবিক নয় কি?


পক্ষীরাজ গড়খাই, মূর্তি ও গড়-কুঁয়ো




    গড়টি সম্পূর্ণ মাকড়া পাথর দ্বার নির্মিত। ধুলিস্যাৎ হয়ে যাওয়া গড়টির মুল অংশের ওপরই বর্তমানে দোলগ্রাম স্কুলটি নির্মাণ করা হয়েছে। যার ফলে তলদেশের যে ভিত্তিপ্রস্তরগুলি আজও রয়েছে তা আর দেখা প্রায় যায়ই না। বাইরের অংশে ভূমিক্ষয়ের প্রভাবে কোথাও কোথাও সামান্য পাঁজর বের হয়ে আছে তবে তাও অতি স্বল্প। এই গড়ের ভেতরেই রয়েছে একটি মাকড়া পাথরে বাঁধানো ইঁদারা জাতীয় ৭ফুট/৭ফুটের সুপ্রাচীন কুঁয়ো। জল বর্তমানে ব্যবহারের যোগ্য নেই। বর্তমানে স্কুল প্রাঙ্গণের মাঝেই উন্মুক্ত ও বিপজ্জনক অবস্থায় অবস্থান করছে। এই প্রাঙ্গণেই অতি প্রাচীন গ্রানাইট পাথরের তৈরি পক্ষীরাজ মূর্তি দুটির একটি পড়ে রয়েছে ততধিক উপেক্ষায়। যাদের অতি সত্তর কার্বন ডেটিং করে সংরক্ষণের উদ্যোগ সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নেওয়া উচিৎ। যদিও একটি মূর্তি নয়াগ্রামের বাণী বিদ্যাপীঠ যুব পাঠাগারে সংরক্ষণ করা হয়েছে।



 এই মূর্তি যুগল সম্ভবত সেই সময় দুর্গটির সিংহদ্বারের দুদিকে শোভা পেত। এই সুসজ্জিত যোদ্ধা মূর্তিদ্বয় ছিল এই দোলগ্রামের পক্ষীরাজ গড়ের প্রধান স্মারক। যে মূর্তিটি বর্তমানে রয়েছে তার অনেকাংশেই ভাঙা। মূর্তির গঠনশৈলী ও উপকরণ দেখে অনুমান করা যায় এই মূর্তি অন্য কোনও স্থান থেকে এখানে আনা হয়েছিল। শিরোস্ত্রান, সজ্জা, দাড়ি, সুঁচোলো গোঁফ দেখে শিবাজী সৈনিকদের সাথে কিছু মিল অনুমান করা যায়। অনেকে অবশ্য এই মূর্তিটিকে শশিসেনা বা সখীসেনা হিসেবেও অবিহিত করেন। তবে তা কবি ভূষণ ফকিররামের সখীসেনা কি না সে বিষয় নিশ্চিত হতে পারি না।



জগন্নাথ-দধিবামন মন্দির, দোলমঞ্চঃ



তবে গ্রামটির যে অংশটি বিশেষ ভাবে টানে তা হল এই জগন্নাথদেবের দধিবামন মন্দিরটি। কয়েক বছর আগেও এই মন্দিরটি ভগ্ন দশায় বিরাজ করত, শোনা যায় এই মন্দিরটি ২০০ বছর আগেই নাকি পুনর্নির্মাণ করা হয়েছিল।তার আগে কালাপাহাড় নামক জনৈক হিন্দু বিদ্বেষী মুসলিম সেনাপ্রধান এর সবটাই ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। যদিও বর্তমানে আবারও নতুন ভাবে সংস্কার হওয়ায় আর তার ভেতর ঐতিহাসিক কৌলিন্য খুব সামান্যই বেঁচে বর্তে আছে। ভেতরে সস্নেহে বিরাজিত প্রায় ২০০ বছর আগের জগন্নাথ দেবের দারুমূর্তি।

    তারই অনতিদূরে অবস্থিত দোলমঞ্চ। দোল পূর্ণিমার দিন এখানেই উদযাপিত হয় দোল উৎসব।


পদ্মদিঘি/জলহরি


গ্রামের শুরুতেই গড়ের সীমা সংলগ্ন সান বাঁধানো ঘাটসহ রয়েছে একটি অতি প্রাচীন সুদৃশ জলাধার। অনেকে একে পদ্মপুকুর বা পদ্মদিঘি নামেই চেনে। কেউ কেউ বলে জলহরি। গ্রামের মানুষজনের কাছে এই জলাশয়টি গ্রীষ্মে আশীর্বাদ স্বরূপ। এই সময় জলের মাঝখানটিতে উঁকি দ্যায় একটি উৎকল রীতিতে তৈরি ভগ্ন দেউলের শিখর। গ্রামবাসীদের কথানুসারে- এই জলাশয়টি প্রতিষ্ঠার সময় মাঝ বরাবর একটি দেউল নির্মাণ করে "জলহরিকে" স্থাটন করা হয়েছিল। তবে অনেকের মত ভিন্ন। তারা মনে করেন ও দেউলটি আদতে "রাজ দেউল"। রাজার প্রমোদ বিহারের জন্য একান্তে কাটানোর জন্য তৈরি করা হয়েছিল। সেই সময় পুরো জলাধারটি সাদা ও লাল পদ্মে সুসজ্জিত থাকত। এর জল কখনও শুকনো হয় না। গ্রীষ্মে কমে যায়, আর জল কমলেই দেখতে পাওয়া যায় জলহরির সুবিন্যস্ত কারুকার্য শোভিত উঁচু চূড়াটি। তবে সে সময় যে কাজের জন্যই তৈরি হোক স্থানটি বড়ই মনোরম।


বালকেশ্বরের মন্দির


গ্রামের ঠিক মাঝ বরাবর রয়েছে ১০০ বছরের পুরাতন একটি শিব মন্দির। এর শৈলী অনেকটাই সস্তনির সহস্রলিঙ্গেরর মতই। গ্রামবাসীরাই উদ্যোগী হয়ে এই মন্দিরটি স্থাপন করেন উড়িষ্যার জনৈক মন্দির স্থপতির দ্বারা। চড়কের সময় আজও রীতি আছে সহস্রলিঙ্গ মন্দিরের অর্ঘ্য বারতিরা নিয়ে এলে নয় মহন্ত দোলায় চেপে মঙ্গল ঘট ডুবিয়ে জল নিয়ে আসেন এই মন্দিরের বালকেশ্বরের জন্য।


ভগবত পুরাণ পুঁথি মন্দির

এই মন্দিরটির একটি অদ্ভুত ঐশ্বর্যের কারণে আজও সমান ভাবে সমাদৃত। সাহু পরিবার কর্তৃক রক্ষিত হয়ে আসছে মন্দিরের দ্বাদশ ভাগবত পুরাণ পুঁথি। পুঁথিটি তালপাতায় প্রাচীন উড়িয়াতে লেখা একটি বিরল নিদর্শন। এটি আজও নিত্যপুজো পায়। 


গ্রামবাংলার এরকম বহু ঐতিহাসিক নিদর্শন আজ নানান অবহেলায়, সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যাচ্ছে রোজ। এই দোলগ্রামও হয়তো একদিন কালের গর্ভে সব বিস্মৃতি নিয়ে হারিয়ে যাবে আর পাঁচটা গ্রামের মতই। আর জঙ্গল, টাঁইড়, টিকর, মহুল, কচড়া, কুড়চি ভুঁড়রু ধীরে ধীরে স্থান পাবে কখনও কোনও ক্ষেত্র সমীক্ষকের গবেষণা পত্রে। মানুষের প্রয়োজন অন্ন বস্ত্র বাসস্থান শিক্ষা ও স্বাস্থ্য। এর ভারসাম্য রক্ষার লড়াই-এ সবাই মশগুল, তারা জানতেও পারবে না কি ভাবে হারিয়ে গ্যালো তাদের শেকড় তাদের ইতিহাস... 

  আদৌ কি ছিল কোনওদিন... কখনও সখনও মনে পড়লে ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যাবে দুটো ডালে বসা টেঁসার সংসার।

    

                                ★★★

Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.