★সুতোর জীবন★
জীবনের নিজস্ব এক দর্শন আছে, অবশ্যম্ভাবি রূপে আছে, আর থাকবে নাই বা ক্যানো! কারণ জীবনের ভেতরেও সত্তার খোঁজ করে আরেকটা জীবন। কেউ কারুর সমব্যথী সমকক্ষ বা সমান্তরাল নয় প্রত্যেকের সত্তাই আলাদা। যেমন গল্প জীবন নয় তেমনই জীবনও গল্প/বা সিনেমা নয়। মানে আমাদের জীবনের কথা বলছি, যারা মধ্যমেধার মধ্যবিত্ত সেন্টিমেন্ট আঁকড়ে বেঁচে উঠি রোজ। কিন্তু তারচেয়েও আশ্চর্যের কি জানো! জীবনের ভেতর অভাবের খামতি নেই কিন্তু অভিযোগও তো কিছু নেই। এক একটি জীবন এক একটি রংমশাল। বাবা বলতেন-- "জীবনের ব্যর্থতাকে উপভোগ কর দেখবি ব্যর্থতারও একসময় ক্লান্তি নেমে আসবে। তারও তৈরি হবে নিজের ওপর অনাস্থা।"
কিন্তু সে সাধনা বড্ড কৃচ্ছ্র। আমাদের মত পাতি মানুষের তা করায়ত্ত করা ততটাই সম্ভব যতটা সূর্যকে আঁজলার জলে ধরা। তারচেয়ে জীবন আমাদের হাতে তুলে দেবে। সত্যিই জীবন মানে একটা শূন্য কিম্বা বৃত্ত। আমরা দূর থেকে শুধু পানু ময়রার জিলিপির প্যাঁচটাই দেখি। দেখি কি ভাবে হাতের মোচড়ে বৃত্ত কিভাবে ছোট থেকে ক্রমশ বৃহৎ-র দিকে যায়। দেখি ভাবি কিন্তু খাওয়ার কথা এলেই সামর্থ্য এসে মুখোমুখি দাঁড়ায়। না এর সবটাই গল্প নয় আবার সবটাই জীবনও নয়। কিম্বা কিছুই নয় সবটুকুই একটা বুদবুদ।
ভেবে দ্যাখো না, সেই হোস্টেল বা মেস জীবনগুলোর সময়ের কথা! তখন খাওয়ার লোভ ছিল, খিদে ছিল শরীরের সামর্থ্যও ছিল। কিন্তু যোগ্যতা ছিল না, মানে মোটা কথায় খরচের ক্ষমতা ছিল না। আর এখন খরচের ক্ষমতা বা যোগ্যতা অর্জন যৎসামান্য করেছি ঠিকই কিন্তু সে খিদেটাও নেই আর সেই লোভটাও। আসলে সময় স্থির জীবনই গতিশীল। চঞ্চল। স্থৈতর্য্যের যাচ্ঞা করতে করতে জীবনের পায়ে নতজানু হই বারংবার। অথচ কি আশ্চর্য দ্যাখো- তা নির্ধারণ করার ক্ষমতা জীবনের নেই, আছে সময়ের। এত অভাব এত অপূর্ণতা এত যাচ্ঞা এত আকাঙ্খা লালন করি বলেই হয়তো গোপনে জীবনের কাছে একটা ম্যাজিকের আশা করি... কখন জীবন তার জাদু ছড়িটা ঘুরিয়ে বলবে --এই নে! গিলিগিলি.. হোগাস-ফোগাস.. ছু..উ..উ
মুঠো খোলো, দেখবে পড়ে আছে একটা অস্তিত্বহীন সংস্কার-- 'পুনর্জন্ম'...
★এক জীবন অনন্ত জীবন★
এই জীবন অর্বাচীন। এই জীবন প্রাচীন প্রাচুর্য নিয়ে মহুল-খঁচের মতন ঝুঁকে আসে দুপুরের কোলে। খুব তো বেশি দিন নয়, এই সামান্য কয়েক দশক আগেও নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্তের মধ্যে অভাব ছিল কিন্তু অভিযোগ ছিল না, না পাওয়ার অতৃপ্তি ছিল, অভিমান ছিল কিন্তু ঈর্ষার লালা সে ভাবে গড়িয়ে পড়তে দেখিনি, ক্রমে দিন বদলেছে রাত বদলেছে জীবন কিম্বা জীবন-যাপন বদলেছে, আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে লালিত পালিত হওয়া ঈর্ষার লালা গড়িয়ে নেমেছে বুক থেকে পেটে। সে সময় মানুষ ঈর্ষা লালন করতে শিখেছিল হয়তো কিন্তু আজ সেই ঈর্ষার বীজ থেকে জন্ম নিচ্ছে ঘৃণা। সর্বত্র ঘৃণা আর ঘৃণা। শুধু ঘৃণা লালন করে চলেছি। এটুকু হলেও এই পর্যন্ত মনস্তত্ত্বের দোহাই দেওয়া যেত কিন্তু এতো শুধু লালন নয়.. লালন নয়.. উদ্যাপন। চারপাশে এতোই ঘৃণার উদ্যাপন যে মাঝে মাঝে অসতর্ক মুহূর্তে নিজের অজান্তে নিজেও সেই সূর্যশিশিরের মুখে পা রেখে ঢুকে পড়ছি অতলান্তে। ডুবে যাচ্ছি কিন্তু বুঝতে পারছি না। যখন দম আটকে আসছে! চারিদিকে একটা অসহিষ্ণুতার বাতাবরণ স্তব্ধ করে দিচ্ছে মস্তিষ্কের কোষগুলোকে, তখন ঘাড় খুঁজছি। না না ওই হিলহিলে পাঁক থেকে বেরোনো জন্য নয়, বরং নিজেদের দোষগুলো অন্যের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে দায় ঠ্যালার জন্য। চারিদিকে এত ঘৃণা, এত শ্লাঘা যে নিজেকে নিজেই চিনতে পারি না। আজকাল দেখি ভালোবাসাটুকুতেও হিসেব হয়। হিসেব হয় কড়ায় গণ্ডায়। আজকাল মানুষ ভালোবাসে ঘৃণা কমে এলে, কারণ তা উদ্যাপনের সাধন। ঘৃণা আহরণের জন্য যত আয়োজন, যত ভালোবাসা।
একটা সময় ছিল যখন বন্ধুরা মিলে একটা সিগারেট পাঁচজনে ভাগ করে খাওয়া হত, এবং তার যে আয়োজন সেটা ছিল তারচেয়েও জমজমাট। সিগারেটের সাদা অংশটা স্কেলে মেপে তাকে সমান পাঁচ ভাগে ভাগ করে কলমে আলতো দাগ দিয়ে নেওয়া হত তারপর বরাদ্দানুসারে যে যার অংশ সে তার ভোগ করত। ভাগ তখনও হত, কিন্তু ভালোবাসাটাকে অক্ষত রেখে ভোগ বস্তুটিকে উদ্যাপনের মাধ্যমে। এখন ঠিক উল্টো। আসলে প্রত্যেকে আমরা অসুস্থ এক অদ্ভুত নেশাগ্রস্ত টানেল দিয়ে হেঁটে চলেছি। নেশাটা ঘৃণার, শ্লাঘার। এতটাই নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছি যে, এর অশ্লীলতাটাও আর নজরে আসে না, ওটা হয়ে উঠেছে সার্বিক ও নান্দনিক। চারিদিকে য্যানো হায়নার উল্লাস। চারিদিকে লেলিহান রক্ত, একে অপরকে বিদ্ধ করছি কিন্তু সে ক্ষতের চেয়ে এই উদ্যাপনের আয়োজন হয়ে উঠছে শ্লাঘার কিরীটী।
কখনও ধর্ম, জাতি, বর্ণ কিম্বা রাজনৈতিক মতাদর্শের নামে কখনও পরিবার, বনেদিআনা, অর্থ কিম্বা বোধের জন্যে। বিনা দোষে বিনা কারণে কারুর রাতারাতি চাকরি চলে যাচ্ছে আর কিছু মানুষ চেপে মেপে রাখা ঘৃণার উদ্গিরণ করে চলেছে! সে কি উল্লাস। সে কি উদযাপন...
আজকাল মাঝে মাঝে মনে হয়--'আমরা আর আদৌ মানুষ আছি তো!!'
★★★
আগের পর্বটি পড়তে নিচের দেওয়া লিঙ্কে ক্লিক করুন--
https://www.goutammahato.site/2024/03/ahammaker-godyo29.html