আহাম্মকের গদ্য(ঊনত্রিশ)


                  সবজান্তার দপ্তর থেকে


ঘটক ও এক কবির মধ্যে কথোপকথনের সময় কবি বললেন-- আমি কবিতা লিখি এই বার্তাটা পাত্রী পক্ষকে জানিয়েছেন তো?

 ঘটক অতি লজ্জিত ভাব নিয়ে পান খাওয়া খরখরে জিভটা দু দাঁতের ফাঁকে চেপে বলল-- না মোহাই, আপনি মাতাল, ভুলক্কড়, চালচুলোহীন বাউন্ডুলে এমনকি আপনি যে হালকা খ্যাপা সেটাও বলেছি, কিন্তু আপনি কবি সেটা বলা হয়নি। এই কথাটা যে ওঁদের কাছে পাড়ব কি ভাবে সেটাই ভাবছি!!

       

কবিতা হল ধ্রুপদি চিন্তার একটি সম্যক রূপ। যা চিরন্তন। আর সেই কবিতাই চিরন্তন হওয়ার ক্ষমতা রাখে যে সত্যিই তার যথাযথ যোগ্য। প্রকৃতিতে অনেক প্রানীই দুই বা ততোধিক সন্তানের জন্ম দ্যায়, কিন্তু পরিবেশে সেই টিকে থাকে যে সব প্রতিকুলতার পরীক্ষায় ক্রম উত্তরণের সোপান খুঁজে পায়। আদতে যাবতীয় সৃষ্টিই ল্যাবে থাকা গিনিপিগ। এখানে সেই গবেষণাপত্রটিই গ্রহণযোগ্যতায় উন্নীত হতে পারে যে ধ্রুপদের সমস্ত মানদণ্ডকে মান্যতা দিয়ে শিখর স্পর্শ করে।

স্ট্রাগল ফর এক্সিসটেন্টস্। কবিতার মধ্যেও একটা অস্ত্বিত্বের লড়াই চলে। এবং যার কোয়ালিটি প্রকৃতি অনুযায়ী শ্রেয় সেই ভবিষ্যত পর্যায়ে স্থৈতর্য্য পায় বাকিরা সময়ের অতলে নিক্ষেপিত হয়। কেউ মনে রাখে না। মনে রাখার প্রয়োজন বোধ করে না। সৃষ্টি রহস্যে এই প্রয়োজন নামক অস্তিত্বটি একটি অদ্ভুত মাপকাঠি। এটা দিয়ে ইহলৌকিক জগতের সবকিছুকেই মাপা যায়, চুল থেকে চরিত্র কিম্বা জ্বর থেকে জগৎ সব।

     অনেকেরই বক্তব্য(এমনকি কিছু প্রাজ্ঞ কবি বন্ধুদেরও), কবিতা আর এখন মানুষ পড়ে না...

আসলে মানুষ কোনও কালেই কবিতা পড়েনি বা পড়ত না। ব্যতিক্রম কিছু তো নিশ্চয়ই আছে তবে তা সার্বিক নয়। এক একজনও যে মাইলস্টোন চিনে বেড়ে ওঠেনি এমনটা নয় তবে তার সংখ্যা সংরক্ষিত। সেই সব নক্ষত্রদের আপনি/আপনারাও চেনেন তাই তাঁদের নামের তালিকা করা বালখিল্যই হবে।

       অনেকের বক্তব্যে থাকে আবার কবিতার জটিলতা বিষয়ক শ্লেষ। এই কথাটাও আবার কিয়দাংশে ঠিক ও বেশির ভাগ অংশেই ভুষি। ক্লাসিক কবিতার রস নিতে গেলে কবিতায় শিক্ষিত হওয়াটা অত্যন্ত জরুরী য্যামোন, ত্যামোনই অনুভূতিগুলির অনুভব স্পর্শ করার বোধ জাগ্রত করতে সমস্ত কুণ্ডলিনী দরজাকে হাট করে খুলে রাখার কৌশলটাও জানা বাঞ্ছনীয়। হ্যাঁ এটা ঠিক ধ্রুপদী ও নিমজ্জিত কবিতা সাধারণত অসহজবোধ্য হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু তার অর্থ এটা নয় যে দুর্বোধ্য করে লেখা কবিতা মানেই তা ক্লাসিক হয়ে উঠবে এই চালাকি অনেকেরই লেখাতে উঁকি ঝুকি মারতে দেখেছি বৈকি। তবে কারুর নাম সম্বোধিত করে বিতর্ক খাড়া করাটা এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। সততা ও সারল্য কবিতার সবচেয়ে বড় শক্তি ও কৌশল। একবার বীতশোক বাবুকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি একটি অসাধারণ জবাব দিয়েছিলেন। বলেছিলেন-"কবিতা হবে সরল কিন্তু গভীর।" 

       এসব বলছি বলে টুকুস করে এটা ভেবে বসবেন না যে আমি কোনও ভাবে কবিতাকে সংজ্ঞায়িত করার বিন্দু মাত্র চেষ্টা করছি। সে ধৃষ্টতা বা মানসিক বৈকল্য কোনটাই আমার নেই। স্বয়ং রবী ঠাকুর পর্যন্ত যেখানে ছোটগল্পকে সংজ্ঞার স্বয়ম্বরে সাজালেও কবিতার বিষয়ে নো কমেন্টস্ বলে স্পিকটি নট হয়ে গ্যাছেন, সেখানে আমার মত অর্বাচীনের এ বিষয় এড়িয়ে যাবে সেটাই স্বাভাবিক নয় কি? অতএব হে পাঠক আমি বিতর্ক রহিত।

         এখন প্রশ্ন আসে এত কবিতা ক্যানো? বা আরেকটু সহজ করে বললে যে অশ্লীল বাক্যবন্ধটি দাঁড়ায় তা অনেকটা এই রকম-- "এত বাজে কবিতার মাঝে ভালো কবিতা যদিও কিছু থাকে সেগুলোও গলে যায়।" কথাটি সম্পূর্ণ মিথ্যে য্যামোন নয় ত্যামোনই সম্পূর্ণ সত্যও নয়, এমনকি কথাটাই সম্পূর্ণ নয়। ঠিক একই প্রশ্ন বছর কয়েক আগে ঠেকে একটি আড়াইশো পাতার পত্রিকাকে সামনে রেখে ঋত্বিকদার সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে বলেছিলাম- "মাইরি ভালো কবিতা বাছাই করতে একটা মুনিস করতে হবে! এত দাম দিয়ে পত্রিকা কিনে মানুষ এত কাঁচা কবিতা পড়বে ক্যানো, এগুলোর কোনও প্রয়োজন ছিল?" ঋত্বিকদা একটি অসাধারণ কথা বলেছিল(হয়তো আজ তার সে কথা মনে নেই)-- "আরে ভালো মন্দ সবই পড়তে হবে। ভালো পড়বে চিত্ত প্রসন্নের জন্য আর বাকিগুলো পড়বে 'ও রকম কখনও লিখব না' ভেবে, নমূনা হিসেেবে।"

       আসলে ভালো বা খারাপ সবটাই সাময়িক। আজ যা ভালো মনে হচ্ছে কাল সেটা নাও হতে পারে, আবার হতেও পারে। ওই যে বললাম প্রয়োজন আর পরিস্থিতি এমন একটি মাপকাঠি যা দিয়ে সৃষ্টির সৃষ্টিতত্ত্বও মাপা যায়। তবে তা ব্যাক্তি ও সময়ের আধারে আধারিত। ব্যাক্তি য্যামোন সময়কে নির্বাচন করবে তেমনই উল্টোটাও। 

   থমাস এডিসন তাঁর বৈদ্যুতিক বাল্ব আবিস্কারের সময় তিনি বহুবার গবেষণায় ব্যর্থ হন, সেই সময় জনৈক্য সাংবাদিক তাঁকে জিজ্ঞেস করেন-- আপনার এতবার ব্যর্থ গবেষণাটি অক্লান্ত ভাবে করে কি লাভ হল ?

এডিসন বলেছিলেন-- যে পথ অবলম্বন করে বারবার গবেষণায় ব্যর্থ হলাম, সেই পথ ভবিষ্যত প্রজন্মের কোনও গবেষককে অন্তত ব্যর্থ প্রচেষ্টায় বিভ্রান্ত হয়ে সময় নষ্ট করতে হবে না, তিনি হয়তো এতে স্বার্থক গবেষণার অনেক কাছে স্বল্প সময়েই পৌঁছে যেতে পারবেন।

    হয়তো সবাই এরকমই ভাবে অথবা একরকম ভাবে না। দুটোই স্বাভাবিক। দুটোই গ্রহণীয়। ভাবছেন-- এ আবার ক্যামোন কথা! তবে কি লেখক অন্তর্দ্বন্দ্বের মানসিক টানেলের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন? হয়তো নয়, সম্পূর্ণতই ঠিক ধরেছেন। ব্যাপারটা কি জানেন, মানুষেরর মধ্যে এই দ্বন্দ্ব না থাকলে সে মানুষ মানুষ হয় না, হয় প্রশ্নহীন ভক্ত।

Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.