আহাম্মকের গদ্য(আঠাশ)

  


সব মা-ই বোধহয় হিসেবে বেশ কাঁচা হয়। তাদের এক হাতা ভাত চাইলে দু হাতা উপুড় করে দেবে, তা সে তোমার পেট নিতে পারুক চাই না পারুক। আর কি আশ্চর্যের বিষয় দেখা যায় সেই ভাত নিঃশব্দে উঠেও যেত! 

   এই মা নামক অদ্ভুত মন্ত্রটি কোনও দর্শন বোঝে না, বাস্তবতা, যুক্তির বাইরে তার বিচরণ ক্ষেত্র। এর সব না বোঝা তালার একটিই মাত্র চাবি- সেটি আবেগ। আমার প্রাইমারি ইসকুলের মাষ্টারমশাই একটি কথা খুব বলত-- "ইমোশান না থাকলে সমাজের মোশান থাকবে কি করে! আবেগই তো বেগের চালক শক্তি।" এই আপ্তবাক্যটার উজ্জ্বল উদাহরণ 'মা'। অন্তত আমার মা। সারা জীবন বাবার সাথে শুম্ভ-নিশুম্ভের মত সম্পর্কে কাটিয়ে দ্যায় কোনও স্বপ্নের দোয়াত না রেখেই। এই সম্পর্কের পরও মা একটা দিন কোথাও চলে গেলেই পরের দিনই বাবার অস্থিরতা বাড়তে শুরু করত। প্রথম প্রথম পরোক্ষ ভাব, পরের দিনই সেটার প্রত্যক্ষ ভাব সর্বসমক্ষে প্রকট হতে শুরু করত। যে সময়ের কথা বলছি তখন আমরা ছোট, টেলিফোনের আদিক্ষেতা অন্তত আমাদের মত নিম্নবিত্ত পরিবারে আসেনি, তাই রক্ষে। পরের দিকে মানে বাবার অবসরের পর এই সুরাসুর সম্পর্ক যখন দু-তরফা বাতাস পেতে শুরু করেছে সেই সময় এই সার্কাস অলিম্পিক বা জেমিনিকেও হার মানাতে পারত। ততদিনে মোবাইলের কিঞ্চিৎ অভ্যুত্থান হতে শুরু করেছে। তাই দিনে বাহান্নবার ফোন করে তার কর্তব্যজ্ঞানহীনতার মর্মর বাণী শোনাত। আর মাও যথারীতি পরেরদিন ফিরে এসে গজগজ করে আমাদের মাথা খারাপ করে দেবে এটাই অলিখিত নিয়ম। তাদের সম্পর্কের এই কেমিস্ট্র আমার কাছে বরাবরের মিস্ট্রিই রয়ে গ্যালো আজও। কারণ বোবারা হাবভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলেও তাতে পারতপক্ষে সমর্থ হয়ে ওঠে না। মায়ের অবস্থা তার চেয়ে ভালো কিছু না। অথবা আমিই সে ভাষা শিখে উঠতে পারিনি আজ এতগুলো বর্ষা ডিঙিয়েও।

      আসলে মা-রা ভীষণ রকমের স্বার্থপর হয়। তারা তার নিজের গোণ্ডীর বাইরে বেরোতে চেষ্টা করে প্রাণপন কিন্তু সে গোণ্ডীর মান ততধিক প্রশস্ত হতে থাকে, গোণ্ডী বাইরে আসতে চেয়ে গোণ্ডীর সম্প্রসারণ তারাই তৈরি করে। মা উবু হয়ে বসে উনুনে কাঠ ঠেলতে ঠেলতে গান করত। বুঝতাম মায়ের মন খারাপ। হাঁটুতে দুটো হাত আর হাতের ওপরে থুতনি, উনুনের লালচে আলোয় আমার মা স্নান করতে করতে গাইত--


“ কুল্‌হি মুড়ায় কুল্‌হি মুড়ায় এক ঝুপড়ি গ


     হুলকি হুলকি বহিন কাঁদে।


     তথায় সে বড় দাদা আসঞে বসিল গ


     চইখ্যের লর পুঁছাতে লাগ্যলঅ


     না কাঁদ্যো না কাঁদ্যো  হামার বহিনী গ


     বনায়ঁ দিব দালান কঠা ঘর।”    


বাবা দড়ির খাটিয়ায় বসে চা খেতে খেতে বলত-- "কাইল্ করম বঠে, তর মাঞ বাপ ঘর যাবেক বলছে রে!"

আমি আকাট গণ্ডমূর্খ কিছুই বুঝতে না পেরেও মাথা নাড়তাম। আসলে আমি না-জেনে বুঝেই এই টরেটক্কার বার্তাবাহক ছিলাম এটা তখন বুঝিনি। তবে এটা বুঝে যেতাম আজ মায়ের স্পেশাল রেসিপির কিছু জুটবে। মায়ের মুখটা ঝুনপুকির মতন উজ্জ্বল হয়ে উঠলে মা শিল-নঢ়ায় দরা চাল বেঁটে শাল পাতায় পিঠাপোড়া করে দিত। সাথে কুর্কুটের চাটনি। সে এক অমোঘ আস্বাদ। যা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ডোমিনোজবাবুকেও গুনে গুনে গোটা আষ্টেক গোল দেবে সে কথা চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি। 


       কর্মজীবন থেকে অবসরের পর টুক্কুস করে বছর কয়েক আগে বাবা চলে গ্যালো। প্রায় ৩৫ বছরের একটা অভ্যেস থেকে মা আচমকাই অব্যহতি পেল। মানুষের জীবন বড্ড অদ্ভুত। তার চাওয়া, না চাওয়া নির্ধারণ হয় সময় মোতাবেক। এই যেমন ধরুন সন্ধেবেলা যদি ভাটিয়ালি ভালো লাগে তবে ভোরটা হবে রবী ঠাকুরের কিম্বা দুপুরে চুনোমাছের ঝাল হলে রাতে বেগুনপোড়া। এই আবর্তে মানুষের ক্ষুদ্র জীবন চক্রবৎ ঘুরে চলে। মা এই নিয়মের বাইরে থেকেও নিয়মের ভেতরেই তার চলাচল। এক দুদিন কিম্বা মাসখানেক কিছুই মালুম পাইনি। একদিন রাতের দিকে ঘুমটা ঝটকায় ভেঙে গ্যালো। বাথরুম যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম মায়ের ঘরের বাতি জ্বলছে। ফিরে এসে ঘরে গিয়ে দেখি মা কুকুর-কুণ্ডলী দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বাতিটা নেভাতে মা ধড়ফড় করে উঠে বসল। আমি বললাম -ঘুমা

বলল- "নাঞ রে, আলো নিভালে নাঞ ঘুম হবেক। উটা জ্বলতে থাকলে মনে হয় কেউ আছে সঁগে। নাইহলে আঁধারে ঘুমের ঘৌরে পাশটা হাঁওসতাঞ যখন বিছনাটা ফাঁকা ঠাহরাই তখন আর সারা রাইত্যটা ঘুম আসে নাঞ।" 

      বুঝতে পারি, যে নিঃসঙ্গতা যে নৈঃশব্দ মা চেয়ে এসেছিল, তা সাময়িক। আসলে সেই নৈঃসঙ্গ এসেছে কিন্তু ওই শূন্যতাই আজ আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে কোনও ডুবন্ত যাত্রীর মত তাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সে চাইছে ভেসে উঠতে কিন্তু কয়েক মুহূর্ত মাত্র। কিছু বাদেই বাস্তবের যাদু ছড়ি তারচেয়েও বৃহত্তর শূন্যের খোঁজে ঠেলে দিচ্ছে ভেতর থেকে ভেতরে।

মৃত্যুর জন্য তো না জানি কতই না রাস্তা

 জিভ বিছিয়ে রেখেছে জীবন 

কিন্তু জন্ম নেওয়ার তো মাত্র একটাই পথ।

 সবাই বলে তাকে নিয়ে লিখতে!  

বুঝি না কি লিখব তার কথা আজকাল, 

যে নিজেকে মৃত্যুর কাছে বাজী রেখে লিখে নিয়েছিল আমায় একদা।

 সে কথার ইতিহাস কেউ তো লেখেনি কখনও। 

যে মুক্তির আশা করি রোজ, 

ভয় হয়--

সেই মুক্তির থেকে তখন যদি মুক্তি চেয়ে বসি! 

এই বাঁধন ফিরিয়ে দেবে কি আমায় আবার? 

বারবার আমার সব কবিতা অসম্পূর্ণ থেকে যায়,

রোজ শব্দ কম পড়ে আজও...

ছেঁড়া আঁচলে হাত মুছে সে

সব অসমাপ্ত কবিতায় শ্রূশুষার আঙুল ছোঁয়ায় 

সব কাজ শেষে নিঝুম রাতে এসে


                                          মা


Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.