আহাম্মকের গদ্য(পঁচিশ)
বাবা, মায়ের সম্পর্কটা ঠিক ক্যামোন ছিল তা ব্যাখ্যা করা আমার মত মামুলি বান্দার যে কম্ম নয় সেটা বোঝানোর জন্য অতিবড় আঁতেল না হলেও চলবে। সাদামাটা স্থূল দৃষ্টিতে একনজরে বলে দিতে পারে কুনুখুড়ার থেকে ভভ্রবুড়া সবাই। সে এক অদ্ভুতুড়ে সম্পর্ক মাইরি। ঘুম থেকে ওঠা থেকে ঘুমোতে যাওয়া অবধি দুজনেই দুজনের ভুল ধরতে সর্বদা তৎপর। আর সেই সুইচটা যার হাতে একবার যাবে ব্যাস তার পোয়াবারো। সূয্যি ওঠা থেকে দুজনের মধ্যে শুরু হয়ে যাবে সেই হূলুস্থূলের কিস্সা। আপাত নজরে আপনার মনে হতেই পারে দুজন দুজনের চরম প্রতিদ্বন্দ্বী, শত্রু। প্রথম প্রথম সেই রাজনীতির শিকার আমি বেশ কয়েকবার হয়েছি বৈকি...
মায়ের সাপোর্টার হয়ে যেই দু একটা উষ্মার কথা বাবা সম্পর্কে তুলেছি ব্যাসস তার মুহূর্ত কয়েকপরেই বুঝেছি আমি একটা নাসমাধানওয়ালা ট্র্যাপে পা দিয়ে ফেলেছি। তারপর থেকে পুরো ১৬টা ঘন্টা তারা দুজনে একপক্ষ আর আমি একজন গোবেচারা নখদন্তহীন তুলতুলে প্রতিদ্বন্দ্বী। যার আত্মরক্ষার বিন্দুমাত্র জায়গার অবকাশ থাকে না।
এই সম্পর্কটা তাদের অহি-নকুলের নয় বরং বলা ভালো সূর্যশিশির টাইপ। পতঙ্গের হাতছানি। আসলে মানুষ সবসময় রাজনৈতিক। সেটা দলীয় হতেও পারে নাও পারে তবে বাঁচা থেকে মৃত্যু, দুঃখ থেকে নান্দনিক সবেতেই তাঁর অনস্তিত্বের অস্তিত্বে বর্তমান। এই কিম্ভুতকিমাকার সম্পর্কটিও এই মনস্তত্ত্বের ব্যতিক্রম নয়। সারাদিন কিচকিচ হাউমাউ শুনতে শুনতে সেই অভ্যেসের চৌকাঠের দিকে আমিও এগিয়ে যাচ্ছিলাম কিনা সে হিসেব আজ অবধি আর করা হয়ে ওঠেনি। বাবা কিন্তু আগে এমনটা ছিল না, বরাবর নিজের মধ্যে ডুবে থাকা একটা অনন্তের দাস ছিল। মাঝে মাঝেই মনে হলে বোনের হারমোনিয়ামটা বাজিয়ে ভাঙা হেঁড়ে বেসুরো গলায় গান গাইত--
"আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা
আপনাকে এই জানা আমার..."
বাবা বড্ড ভালো শ্রীখোল মাদল ধমসা বাজাত। এর আগের বেশকিছু গদ্যে সে কথা পাঠকদের বলেছি। প্রায়ই অফিস থেকে ফিরে হাত পা ধুয়ে চা খেয়েই বসে পড়ত। মা বলত- 'ই গলায় হড়-মিতান, পাড়া-পড়শি অতিষ্ট করঞে নাঞ তুললেই নাঞ।'
বাবা বলত- 'উটা তুমি বুঝ্যবে নাঞ! তবে ইটা জানিঞ থাক... "গাহইতে গাহইতে গলা আর বহইতে বহইতে নালা"
বয়ে বয়ে মিত্রকাকাদের নালাটা হয়েছিল বটে যেটা পরে মিউনিসিপলিটিও রেকগনাইজ করে দিয়েছিল বটে কিন্তু বাবার গলাটার রেকগনিজেসন পাওয়া শেষ অবধি হয়নি। তবে এই ঘরের আনাচে-কানাচে ছাদে শার্সিতে সে কখনও কখনও নিশুতি রাতের দিকে গুঞ্জন করে..
মা বরাবরই আবেগের পুজারি। অসম্ভব রকমের জেদ ও অস্থিরতা। 'পায়ের তলায় সরসে।' দু তিন মাস ছাড়াই বাড়ি থেকে কোথাও একটা যাবেই তবে ওই গিরগিটির দৌড় বান্নাগড়া। বাপের ঘর কখনও সখনও অন্য কোথাও কুটুমবিতা। তবে আশ্চর্যের বিষয় এটা নয় আমার অবাক লাগত বাড়ির বাইরে মায়ের গ্রহনযোগ্যতা। মায়ের উপস্থিতি যেকোনও জায়গায় চারচাঁদ উদ্ভাসিত হত। সকলের কাছে বড়খুকু মানে উচ্ছ্বাসের নাম। কিন্তু বাড়ি এলেই তার রঙ ধুসর। আসলে সে পৃথিবীটা নিজের মত করে দেখতে চেয়েছে চিরটাকাল। জঙ্গল মাকে নাকি ডাকে বারবার। করমডাল গাড়া হতে না হতেই ওদের বড়খুকুর গীত হাজির হয়ে যেত। বাঁশবনে নাচ হত ধুঁয়াধার আমরা তখন ছোট তাই আমাদের আনাগোনা ছিল অবলীলায়। আজ বুঝি মায়ে এই জিনটা আমার মজ্জায় পুতে দিয়েছে সেই জন্মের পর থেকে। এটা বুঝতে বুঝতে বুঝতে... নিজেকে চিনে ফ্যালার একটা মামুলি কৌশল রপ্ত করতে শিখছি আজও, আর সেই কৌশলের মাঝে মাঝে দেওয়ালের পলেস্তরা ভেদ করে গুঞ্জিত হয়--
"আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না
সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা
আপনাকে এই জানা আমার...
अजहुँ तेरा सब मिटै, जो जग मानै हार।
घर में झजरा होत है, सो घर डारो जार।।
সব মা-ই বোধহয় হিসেবে বেশ কাঁচা হয়। তাদের এক হাতা ভাত চাইলে দু হাতা উপুড় করে দেবে, তা সে তোমার পেট নিতে পারুক চাই না পারুক। আর কি আশ্চর্যের বিষয় দেখা যায় সেই ভাত নিঃশব্দে উঠেও যেত!
এই মা নামক অদ্ভুত মন্ত্রটি কোনও দর্শন বোঝে না, বাস্তবতা, যুক্তির বাইরে তার বিচরণ ক্ষেত্র। এর সব না বোঝা তালার একটিই মাত্র চাবি- সেটি আবেগ। আমার প্রাইমারি ইসকুলের মাষ্টারমশাই একটি কথা খুব বলত-- "ইমোশান না থাকলে সমাজের মোশান থাকবে কি করে! আবেগই তো বেগের চালক শক্তি।" এই আপ্তবাক্যটার উজ্জ্বল উদাহরণ 'মা'। অন্তত আমার মা। সারা জীবন বাবার সাথে শুম্ভ-নিশুম্ভের মত সম্পর্কে কাটিয়ে দ্যায় কোনও স্বপ্নের দোয়াত না রেখেই। এই সম্পর্কের পরও মা একটা দিন কোথাও চলে গেলেই পরের দিনই বাবার অস্থিরতা বাড়তে শুরু করত। প্রথম প্রথম পরোক্ষ ভাব, পরের দিনই সেটার প্রত্যক্ষ ভাব সর্বসমক্ষে প্রকট হতে শুরু করত। যে সময়ের কথা বলছি তখন আমরা ছোট, টেলিফোনের আদিক্ষেতা অন্তত আমাদের মত নিম্নবিত্ত পরিবারে আসেনি, তাই রক্ষে। পরের দিকে মানে বাবার অবসরের পর এই সুরাসুর সম্পর্ক যখন দু-তরফা বাতাস পেতে শুরু করেছে সেই সময় এই সার্কাস অলিম্পিক বা জেমিনিকেও হার মানাতে পারত। ততদিনে মোবাইলের কিঞ্চিৎ অভ্যুত্থান হতে শুরু করেছে। তাই দিনে বাহান্নবার ফোন করে তার কর্তব্যজ্ঞানহীনতার মর্মর বাণী শোনাত। আর মাও যথারীতি পরেরদিন ফিরে এসে গজগজ করে আমাদের মাথা খারাপ করে দেবে এটাই অলিখিত নিয়ম। তাদের সম্পর্কের এই কেমিস্ট্র আমার কাছে বরাবরের মিস্ট্রিই রয়ে গ্যালো আজও। কারণ বোবারা হাবভাবে বোঝাতে চেষ্টা করলেও তাতে পারতপক্ষে সমর্থ হয়ে ওঠে না। মায়ে অবস্থা তার চেয়ে ভালো কিছু না। অথবা আমিই সে ভাষা শিখে উঠতে পারিনি আজ এতগুলো বর্ষা ডিঙিয়েও।
আসলে মা-রা ভীষণ রকমের স্বার্থপর হয়। তারা তার নিজের গোণ্ডীর বাইরে বেরোতে চেষ্টা করে প্রাণপন কিন্তু সে গোণ্ডীর মান ততধিক প্রসস্ত হতে থাকে, গোণ্ডী বাইরে আসতে চেয়ে গোণ্ডীর সম্প্রসারণ তারাই তৈরি করে। মা উবু হয়ে বসে উনুনে কাঠ ঠেলতে ঠেলতে গান করত। বুঝতাম মায়ের মন খারাপ। হাঁটুতে দুটো হাত আর হাতের ওপরে থুতনি, উনুনের লালচে আলোয় আমার মা স্নান করতে করতে গাইত--
“কুল্হি মুড়ায় কুল্হি মুড়ায় এক ঝুপড়ি গ
হুলকি হুলকি বহিন কাঁদে।
তথায় সে বড় দাদা আসিয়ে বসিল গ
চইখ্যের লর পুঁছাতে লাগিল
না কাঁদ্যো না কাঁদ্যো হামার বহিনী গ
বনায়ঁ দিব দালান কঠা ঘর।”
বাবা দড়ির খাটিয়ায় বসে চা খেতে খেতে বলত-- "কাইল্ করম বঠে, তর মাঞ বাপ ঘর যাবেক বলছে রে!"
আমি আকাট গণ্ডমূর্খ কিছুই বুঝতে না পেরেও মাথা নাড়তাম। আসলে আমি না জেনে বুঝেই এই টরেটক্কার বার্তাবাহক ছিলাম এটা তখন বুঝিনি। তবে এটা বুঝে যেতাম আজ মায়ের স্পেশাল রেসিপির কিছু জুটবে। মায়ের মুখটা ঝুনপুকির মতন উজ্জ্বল হয়ে উঠলে মা শিল-নড়ায় দরা চাল বেঁটে শাল পাতায় পিঠাপোড়া করে দিত। সাথে কুর্কুটের চাটনি। সে এক অমোঘ আস্বাদ। যা আজকের দিনে দাঁড়িয়েও ডোমিনোজবাবুকেও গুনে গুনে গোটা আষ্টেক গোল দেবে সে কথা চ্যালেঞ্জ নিয়ে বলতে পারি।
কর্মজীবন থেকে অবসরের পর টুক্কুস করে বছর কয়েক আগে বাবা চলে গ্যালো। প্রায় ৩৫ বছরের একটা অভ্যেস থেকে মা আচমকাই অব্যহতি পেল। মানুষের জীবন বড্ড অদ্ভুত। তার চাওয়া, না চাওয়া নির্ধারণ হয় সময় মোতাবেক। এই যেমন ধরুন সন্ধেবেলা যদি ভাটিয়ালি ভালো লাগে তবে ভোরটা হবে রবী ঠাকুরের কিম্বা দুপুরে চুনোমাছের ঝাল হলে রাতে বেগুনপোড়া। এই আবর্তের মানুষের ক্ষুদ্র জীবন চক্রবৎ ঘুরে চলে। মা এই নিয়মের বাইরে থেকেও নিয়মের ভেতরেই তার চলাচল। এক দুদিন কিম্বা মাসখানেক কিছুই মালুম পাইনি। একদিন রাতের দিকে ঘুমটা ঝটকায় ভেঙে গ্যালো। বাথরুম যেতে যেতে লক্ষ্য করলাম মায়ের ঘরের বাতি জ্বলছে। ফিরে এসে ঘরে গিয়ে দেখি মা কুকুর-কুণ্ডলী দিয়ে ঘুমোচ্ছে। আমি নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে বাতিটা নেভাতে মা ধড়ফড় করে উঠে বসল। আমি বললাম -ঘুমা
বলল- নাঞ রে, আলো নিভালে নাঞ ঘুম হবেক। উটা জ্বলতে থাকলে মনে হয় কেউ আছে সঁগে। নাইহলে আঁধারে ঘুমের ঘৌরে পাশটা হাঁওসতাঞ যখন বিছনাটা ফাঁকা ঠাহরাই তখন আর সারা রাইত্যটা ঘুম আসে নাঞ।
বুঝতে পারি, যে নিঃসঙ্গতা যে নৈঃশব্দ মা চেয়ে এসেছিল, তা সাময়িক। আস সেই নৈঃসঙ্গ এসেছে কিন্তু ওই শূন্যতাই আজ তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে কোনও ডুবন্ত যাত্রীর মত তাকেও ভাসিয়ে নিয়ে যেতে চাইছে। সে চাইছে ভেসে উঠতে কিন্তু কয়েক মুহূর্ত মাত্র। কিছু বাদেই বাস্তবের যাদু ছড়ি তারচেয়েও বৃহত্তর শূন্যের খোঁজে ঠেলে দিচ্ছে ভেতর থেকে ভেতরে।
মৃত্যুর জন্য তো না জানি কতই না রাস্তা
জিভ বিছিয়ে রেখেছে জীবন
কিন্তু জন্ম নেওয়ার তো মাত্র একটাই পথ।
সবাই বলে তাকে নিয়ে লিখতে!
বুঝি না কি লিখব তার কথা আজকাল,
যে নিজেকে মৃত্যুর কাছে বাজী রেখে লিখে নিয়েছিল আমায় একদা।
সে কথার ইতিহাস কেউ তো লেখেনি কখনও।
যে মুক্তির আশা করি রোজ,
ভয় হয়--
সেই মুক্তির থেকে তখন যদি মুক্তি চেয়ে বসি!
এই বাঁধন ফিরিয়ে দেবে কি আমায় আবার?
বারবার আমার সব কবিতা অসম্পূর্ণ থেকে যায়,
রোজ শব্দ কম পড়ে আজও...
ছেঁড়া আঁচলে হাত মুছে সে
সব অসমাপ্ত কবিতায় শ্রূশুষার আঙুল ছোঁয়ায়
সব কাজ শেষে নিঝুম রাতে এসে