আহাম্মকের গদ্য(ছাব্বিশ)
এই প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের বহু প্রাচুর্য ও স্বচ্ছলতার উদ্ যাপন আছে কিন্তু আদতে তারা দীন, দরিদ্র। এই দারিদ্রতা তাদের যাপনে নয় মননে। তাদের কোনও অতীতের ঐতিহ্য নেই। তাই সেই ঐতিহ্যের কোনও গল্পও নেই, আর স্মৃতির কূপগাড়ুটিও তাদের শূন্য।
এর চেয়েও ভয়াবহ হল এই প্রজন্মের কাছে বিস্ময়বোধ হারিয়ে যাচ্ছে।তার আর কোনও কিছুতেই চমৎকৃত হতে ভুলে যাচ্ছে। তারা আর দিগন্ত দেখে বা প্রকাণ্ড বৃক্ষের সমাহার দেখে মুগ্ধ হয় না। চোখ থেকে য্যানো তাদের মুগ্ধতা কেউ ছিনিয়ে নিয়েছে।
তারা বহুরস থেকে বঞ্চিত, আবার এটাও ঠিক বহু নতুন নতুন সাধন ও তা নিঃসৃত রসে তারা বেশী সাচ্ছন্দ্য বোধ করে। হতে পারে আমাদের সময়ের অনুভূতিগুলো ওদের কাছে তেমন গুরুুত্বের নয়, কিম্বা হতে পারে সেই সব আনন্দের স্বাদ তাদের আলজিভ স্পর্শ করতে না দেওয়ায় সেই স্বাদের রুচি বাঁক নিয়েছে অত্যাধুনিক অলিন্দে। হয়তো এটাই গতিশীলতার দান।
আমাদের প্রজন্মটি এমন এক প্রজন্ম যারা লাগাতার কয়েকটি যুগ অতিক্রম করে আজ এই সময়টিতে এসে দাঁড়িয়েছি। আমাদের কাছে চাওয়াটা যতটা ছোট ছিল পাওয়াটা ছিল ততদিন সংকীর্ণ ও রুগ্ন। চাইতাম রসগোল্লা পেতাম চুইটার দোকানের পোকড়ি, সেটাও কালেভদ্রে, সব সময় নৈব চ। কিন্তু এতদসত্বেও আমার আমাদের সঞ্চয় ছিল। অর্থাৎ না পাওয়া গুলো যে মূল্যবান সঞ্চয় সেসব তখন না বুঝলেও আজকের দিনে এসে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে ওঠে। হয়তো সে কারণেই তখন গোপনে প্রায় সবার একটা করে কূপগাড়ু (লক্ষ্মীর ভাড়) থাকতো। আর থাকতো সময় বিলাসে তা থেকে সুনিপুন ভাবে মুদ্রা বের করে আনা ঝাঁটার কাঠির কৌশল। স্বয়ং বিশ্বকর্মারও সে নৈপূণ্য দেখে ঈর্ষান্বিত হওয়ার কথা। শূদ্রক তার মৃচ্ছকটিকমে চোরের সিন্ধ কাটা যে শিল্প নৈপুণ্য উল্লেখ করেছেন তার অতি বলে মনে হয় সেসব কীর্তির কাছে।
যদিও যুগ বিষয়টা হেব্বি গোলমেলে। এর যথাযথ সংঙ্গা যে অভিপ্রায় বলছি, সেই মতো দৃষ্টিভঙ্গিতে প্রায় নেই বললেই চলে। পুরাণে যুগের যে সংজ্ঞা ও সময়কাল উল্লেখিত হয়েছে সেটা এক্ষেত্রে বিশেষ খাটেনা। তাই অন্যভাবে ভাবলে বলতে হয়-- যুগ কখনো সময়ের মুখাপেক্ষী মোটেও নয় বরং যুগ নির্ধারণ হয় একটা ফোর্স বা বলের ওপর, যা প্রতিফলিত হয় আমাদের দৈনন্দিন যাপন প্রণালীর মধ্য দিয়ে তাই এই আপ্তবাক্যটিকে সামনে এনে দাঁড় করালে বেশ কিছু উদাহরণ চোখের সামনে নেচে ওঠে, সেখানে থাকে কয়েকটা বিপ্লবচেতনা বা রেভুলেশন। এই কলের গানের কথাই ধরুন না--
জলসা-- রেডিও-- রেকর্ড/গ্রামাফোন-- টেপ রেকর্ডার/ক্যাসেট-- ফ্লপি-- সিডি--Mp3-- আইপ্যাড-- এফ.এম-- মাইক্রোচিপ-- এখন তো সরাসরি হার্ডডিক্স ডেটাবেস ব্যবহার হয় (এই হার্ডডিক্সেরও অনেকগুলি পর্যায় সে পেরিয়ে এসেছে)
আবার অডিও ভিজুয়াল এর দিকটা দেখতে গেলে সেখানে দেখতে পাব-- ভি.সি.আর--ভি.সি.পি--ডি.ভি.ডি--মাইক্রোচিপ-- এছাড়াও হার্ডডিস্ক বা গুগল ড্রাইভ।।
অত্যাধুনিক সাধন এসেছে ঠিকই আমাদের হাতে তা সত্ত্বেও পুরনো সঞ্চয় কি নোট বাতিলের মতো বাতিল হয়েছে? না বোধহয়, স্মৃতিসত্তার সাথে সবই জুড়ে আছে। শুধু তার ক্ষয়িষ্ণু গতর দেখে মাঝে মধ্যে পীড়া দ্যায় বৈকি। সেই সময়ের সিরিয়াল বা ডিজনির কার্টুন ক্যারেকটারগুলির মধ্যেও অদ্ভুত শৈল্পিক সত্তার মেলবন্ধন পুরো শৈশবকে আজও আচ্ছন্ন করে রাখে। রামায়ণ, মহাভারত বাদেও
(ক)লেখু
(খ)নুক্কড়
(গ)ব্যোমকেশ বক্সি
(ঘ)তহকিকত
(ঙ) করমচাঁদ
(চ) মালগুড়ি ডেজ
(ছ) আঙ্কেল ক্রুজ
(জ) হি ম্যান
(ঝ) মুঙ্গেরিকে ভাই নওরঙ্গিলাল
(ঞ) দেখ ভাই দেখ
(ট) শ্বেত-কপোত
(ঠ)সার্কাস
(ড) রিপোর্টার...
সে সবই সোনায় লেখা দিন। তবে এই টি.ভির পর্বটাও আসে শৈশবের প্রায় শেষ দিকে। গোড়ার দিকে তো টি.ভি জিনিসটাই ছিল হতবাক করার মত একখানা আস্ত গল্প। বাবা কাকারা গল্প শোনাতো এর। কেমন একটা কাচের চারকোনা বাক্সে সিনেমার মত দৃশ্য ভেসে ওঠে। কিভাবে ওঠে সেই নিয়ে গাঁয়ের কচাপালের ভুতের মতন নানা মিথ ও মিথ্যা শুনতাম। শুনতাম আর গিলতাম। এসব ঘটনার অনেক পরে টি.ভির সাথে পরিচয় হয়। ফি রোববার প্রায় দু ক্রোশ হেঁটে বোনকে নিয়ে রামায়ণ দেখতে যাওয়ার মধ্যে যে অনাবিল আনন্দ ছিল তা দূরত্বের কষ্টের তুলনায় অতি নগন্য। সেই ভানসিং ডাঙা, হুটমা ডাঙা পেরিয়ে বামুনপাড়া হয়ে পেরোতে পেরোতে দেখতাম কোনও কোনও দিন লুলুদাদু খেজুর গাছের হাঁড়ি পাড়ছে, সে সব পেরিয়ে এসে পৌঁছোতাম চাটু ডাক্তারের উঠোনে। মাঝের সময়টুকুতে সাতুবুঢ়া গান ধরত--
"এহ ঘাটে জবঅরা সেহ ঘাটে জবঅরা
মাঞে কহেক বিটি কাঁদে..."
আবার কোনও কোনও দিন গাইত--
"এক মুঠা চার মাঞ গ মাড় রাঁধল
সঞা হামর রহঅল উপাস
কিনা কহবা অকে মর ভেলি ডেরি গ
তাকর তেঁহেঁ মনওআ উদাস।"
তবে সেই সময় আমরা অপেক্ষা করতাম পাইটকার দাদু আর "ঘরগুষ্টি অপেরার।
(বিঃদ্রঃ- এই ঘরগুষ্টি অপেরা নিয়ে লিখব কোন একসময়)