মকর সংক্রান্তি নাকি টুসুপরব?

 মকর সংক্রান্তি নাকি টুসুপরব?





উৎসব সার্বিক এতে আমার কোনও দ্বিমত নেই, বরং আনন্দ হয়, খুশি খুশিই লাগে এটা ভেবে যে প্রান্তিক পরম্পরা সার্বিক হচ্ছে। কিন্তু উৎসব আর রীতি-রিওয়াজ প্রতিপালন এক নয়। মকরপরব বা টুসু পরবের যে রিচুয়াল(নেগাচার) সারা বাংলায় প্রতিপালিত হয় তার সিংহ ভাগই কুড়মি উপজাতির রীতির পরিশীলিত রূপ। কিন্তু কি আশ্চর্য দেখ সবগুলাই আসলে নবান্নকে কেন্দ্র করেই। আদতে কৃষিজীবি মানুষদের। আর সৌব পরবগিলার লে প্রচীন হল্য এই মকর পরব। অর্থাৎ একটা সহজ সমীকরণ টানা যায় সব পরবগুলাই মকর থেকে ইনফ্লুয়েন্সড। কারণ মকরের পরের দিন নতুন বছর আর বাকিদের কারুর পালন হয় না। শুধুমাত্র কুড়মিদের বাদে। বাংলায় যারা মকর সংক্রান্তি পালন করে তাদের সবার নয়।


বিহুঃ 

বিষ্ণুপ্রসাদ রাভার মতে বিহু শব্দটি কৃষিজীবী ডিমাস জনজাতির মধ্যে প্রচলিত শব্দ। তারা তাদের দেবতা ব্রাই শিবরাইকে শস্য উৎসর্গ করে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রার্থনা করেন। বি শব্দটির অর্থ প্রার্থনা করা এবং শু শব্দের অর্থ শান্তি ও সমৃদ্ধি। বিশু শব্দ থেকে বিহু শব্দের উৎপত্তি। অন্যমতে হু শব্দটির অর্থ দান করা। বিহু মূলতঃ এক কৃষি ভিত্তিক উৎসব। মূলত তিন প্রকার বিহু উৎসব পালিত হয়, এগুলি হল ব’হাগ বিহু বা রঙ্গালী বিহু, কাতি বিহু বা কঙ্গালী বিহু এবং মাঘ বিহু বা ভোগালী বিহু।


ভোগালী বিহু বা মাঘ বিহু 

মাঘ মাসে ভোগালী বিহু বা মাঘ বিহু পালন করা হয়। ভোগালী শব্দটি ভোগ বা খাদ্য থেকে এসেছে। এই বিহু তিন দিন ধরে পালন করা হয়। পৌষ সংক্রান্তির দিনের বিকেল বেলায়, যা উরুকা নামেও পরিচিত, যুবকেরা নদীর তীরে মাঠে উৎপাদিত শস্যের খড় দিয়ে ভেলাঘর নামক কুটির নির্মাণ করেন এবং তা দিয়ে রাত্রে মেজি নামক আগুন জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেন। রাত্রিবেলায় তারা মেজির চারপাশে জড়ো হয়ে বিহুগীতের গান করেন, ঢোল আদি বাদ্যযন্ত্র বাজান এবং সমবেতভাবে খাবার খান। পরের দিন সকালে তারা স্নান করে মূল মাজিতে আগুন জ্বালান এবং ওই আগুনে পিঠা ও সুপুরি ছুড়ে দেন। এরপর তারা অগ্নির নিকট প্রার্থনা করেন। এরপর এলাকার ফলগাছগুলিতে শস্য বেঁধে দেওয়া হয়। এই দিন সারাদিন ধরে মোষের লড়াই, মোরগের লড়াই প্রভৃতি ক্রীড়া চলতে থাকে।


     আসামে এর প্রচলন খুব সম্ভব চা বাগানের শ্রমিকদের হাত ধরেই। অনুমান করা যায় কুড়মিরা আসাম আসার পরপর থেকেই এর প্রচলনের তীব্রতা।

" চাল মিনি আসাম যাব

দেশে বোড্ডো দুখ রে

আসাম দেশে রে মিনি

চা বাগান হরিয়াল"


পোঙ্গলঃ যতদুর মনে পড়ছে এটা --

"Pongal is a harvest festival celebrated by the Tamil community. It is a celebration to thank the Sun, Mother Nature and the various farm animals that help to contribute to a bountiful harvest. Celebrated over four days, Pongal also marks the beginning of the Tamil month called Thai, which is considered an auspicious month. It usually falls on the 14th or 15th of January each year.


Pongal is also the name of the dish made and eaten during this festival. It is a mixture of boiled sweet rice. It is derived from the Tamil word pongu, which means “to boil over”.


এটা তামিলনাড়ুতে ব্রাহ্মণরাও পালন করে। কিন্তু উৎসবটাই পালন করতে যে রিচুয়ালগুলো আছে তা সবই দ্রাবিড়ীয় কালচার। ওদিকের কুণবিরা এর রিচুয়াল(নেগাচার) পাই টু পাই অনুসরণ করে। আর অন্যরা যদিও করে সেটা যৎসামান্য, তাতেও দ্রাবিড়ীয় প্রভাব সুস্পষ্ট।


লোহরিঃ 

 এই উৎসবটি দক্ষিণায়ণের শেষ সূচিত করে। ভারতীয় উপমহাদেশের উত্তর অঞ্চলের হিন্দু ও শিখ ধর্মাবলম্বীরা লোহরিকে শীতের শেষ বলে চিহ্নিত করে। তারা এটিকে লম্বা দিনের আগমন এবং সূর্যের উত্তরায়ণকে স্বাগত জানানোর ঐতিহ্য বলে মনে করে। এটি চান্দ্র-সৌর বিক্রম সংবৎ (সৌর-চান্দ্র বিক্রমি বর্ষপঞ্জী) সৌর অংশ অনুযায়ী মকর বা পৌষ সংক্রান্তির আগের রাতে পালন করা হয়। এই উৎসব মাঘী নামেও পরিচিত এবং প্রতি বছর এটি প্রায় একই তারিখে (১৩ জানুয়ারি) পড়ে।

      দিল্লি, পঞ্জাব, হরিয়ানা, জম্মু-কাশ্মির ও হিমাচলের সমস্ত অঞ্চলের হিন্দু, শিখ এবং মুসলমানরা এই উৎসবটি পালন করে। লক্ষনীয় পাঞ্জাব, হরিয়ানা কৃষি নির্ভর প্রদেশ। যদিও লোহরির সাথে মকরপরবের কোনও সংযোগ নেই শুধু দার্শনিক আঙ্গিকটুকু বাদে (দক্ষিনায়ণ শেষে উত্তরায়ণের আগমনের স্বাগত বার্তাটুকু ছাড়া)।


শিমগ্গা সগ্গুন/ সাব্বরী সগ্গুনঃ 

ছত্তিশগঢ়, মধ্যপ্রদেশ, ও উড়িষ্যার কিছু অংশে কোইতুররা একটি পরব পালন করে থাকে যার নাম শিমগ্গা সগ্গুন। এই শিমগ্গা সগ্গুনের সময়টা যদিও ফাল্গুন মাসে তবে এই উৎসবটিও কৃষি কেন্দ্রিক। মূলত বোরো চাষ বা রবীশস্যকে সামনে রেখে। এটা কোনও তেওহার নয় বরং পরব বলা ভালো, কারণ এই পরবটি চলে  ১৫দিন ধরে। এই পরবটি চারটি পর্যায় বিভক্ত।

 (১)রোন রজগ্গা গঙ্গো পাবুন( ঘরদোর মহল্লা সাফ-সাফাই)

(২) অদ্দীটিয়া পেন গোঙ্গো(নতুন বছরকে স্বাগত জানানো)

(৩) উনহারী নবা-খাদাই পাবুন( নতুন ফসলের নতুন খাদ্য পূর্বজদের উৎসর্গ)

এবং

(৪) শিমগ্গা-সগ্গুন বা সাবরী সগ্গুন/সগ্গা সগ্গুন(দোল/হোলি মিলন উৎসব)


কুড়মিদের ও তাই-আঁউড়ি', 'চাঁউড়ি', 'বাঁউড়ি', 'মকর'। শুধু উৎপাদিত শস্যের সমকাল অনুসারে উদ্ যাপনটা ভিন্ন। আর পর্বগুলির অভিধা(term) আলাদা। বিষয়টা হুবহু এক।



দোল/হোলি উৎসবঃ 

এই প্রসঙ্গে বলাটা অত্যন্ত সঙ্গত হবে দোল উৎসবটা নিয়ে। দোল শব্দটা 'ডোল' থেকে আসাটা অসম্ভব কিছু কি? কারণ বলা হয় দোল-যাত্রা। যাত্রা শব্দটি 'আখ্যাইন যাতরা'তেও ব্যবহার লক্ষনীয়। আর যাত্রা শব্দটি যদি গমনের প্রতিশব্দ হিসেবে গ্রহন করি তবে সেটিও কিন্তু সন্দের নিরসন করছে না কারণ চউডোল> চউড়োল>চউডল নিয়েই মকরডুবের উদ্দেশ্যে গমন করে থাকেন কুড়মিরা। হয়তো উৎসব সর্বজনীন হতে গিয়ে এই দোলটিও মকরের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিল কোন এক সময় কিন্তু কালক্রমে তা ভিন্ন উৎসবের মেজাজ নেয় ব্রাহ্মণ্যবাদের হাত ধরে। অনেকেই হয়তো 'ভাগবত' মহপুরাণের হোলিকা ও প্রহ্লাদের পৌরাণিক কাহিনীর অবতারণ করবেন ঠিকই কিন্তু এটাও উল্লেখ্য যে এই মহাপুরাণেরর রচনাকাল ৪খ্রী-১০খ্রীঃ-র মধ্যে ভগবান বিষ্ণুর মাহাত্ম্য বর্ণনের নিমিত্তে। আর এই আলোচনাটা শুরুই হচ্ছে খ্রীস্টপূর্বাব্দকে সামনে রেখে। তার কত আগে সেটা অনুমান করা দুঃসাধ্য বিষয় কারণ দোলের সাথেও বর্ষসূচনার একটা গভীর সম্পর্ক লক্ষ্যনীয়। এমনকি চাঁচুড়ি/ বুড়ি ঘর পোড়ানোর মতই মকরের দিনও ছোট ছোট ঘর বানিয়ে পোড়ানোর রেওয়াজ দু-দশক আগেও বেশ চোখে পড়ত। আসলে চাঁউড়ির দিনে ঘর-দোর মহল্লা সাফ-সুত্র করে অবাঞ্ছিত গাছ-গাছড়া, জিনিস পত্র পুড়িয়ে উদযাপনের নাম। হয়তো এই রীতিকে পুরাণ গ্রহণ করে নিজের মত করে।

অর্থাৎ বলার অভিপ্রায় এটাই যে এই উৎসব উচ্চবর্ণ থেকে নিম্নবর্ণ আদিবাসী সংস্কৃতিকে নিজের মতন করে অন্য সবাই প্রতিপালন করছে। এমন কি স্থান ও কাল ভেদে আদিবাসীও পরিবর্তন করে নিয়েছে। কিন্তু কুড়মিরাই একমাত্র গোষ্ঠী যারা তাদের পুরখানি সংস্কৃতি একই ভাবে ধরে রেখেছে। কোইতুররাও পরম্পরা ঠিক রেখেছে ঠিকই কিন্তু টাইমজার্নি সাথে উদযাপনের সময়টা সামান্য হেরফের হয়েছে। আমার তো মনে হয় এই সময়কালটা নিতান্ত অর্বাচীন। কারণ বোরো চাষটার ইতিহাস খুব পুরানো নয়। তাই যা ইঙ্গিত পাই তাতে অশোকের জৌগড়া ও ধৌলি শিলালিপিতে উল্লেখিত শস্য উৎসব আদতে মকরপরবই। আর আর্যরা কৃষি সে ভাবে জানত না। তাই পোঙ্গলটা সন্দেহের ঊর্ধে নয়।


       বৈজ্ঞানিক বা সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে আলোচনা না হয় অন্য কোনও সময় করা যাবে। সেটা নিয়ে বলতে গেলে পেজ ছোট পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা এবং ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে।

       ভালো থাকুন। মকরপরবের সাগুন বাঞ্ছা


আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন

 https://lekhajokha-ek-dasaker-goutam-mahato.blogspot.com/2023/01/makar-parab-or-tusu-parab-part2.html


Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.