কুড়মালি ও ব্রজবুলি
শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন ও বৈষ্ণবপদাবলী যে ভাষাটিকে সানে রেখে এগিয়েছে সেটা বহুল শ্রুত ও প্রচলিত প্রচারিত। কিন্তু এই সব পদের ভাষাতাত্ত্বিক ধারা বয়ে এসেছে চুটিয়া নাগপুরের কুড়মালি থেকে সাদরি পাঁচপরগণিয়া হয়ে ব্রজবুলির স্রোতে। তাই
ব্রজবুলির চমৎকার ইতিহাস দিয়া আচার্য সুকুমার সেন বলছেন— “ব্রজবুলি পদাবলীর ইতিহাসের আর জের টেনে লাভ নেই। সপ্তদশ শতাব্দীর রচনার অনুবৃত্তি অষ্টাদশ শতাব্দী পেরিয়ে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত পৌঁছেছে। কিন্তু সে কেবলই রসহীন শুষ্ক পত্রের মর্মর। তবে ব্রজবুলি পদাবলীর ইতিহাসে যিনি সমাপ্তির দাঁড়ি টেনে দিলেন তিনি। শুধু বাঙলা দেশের নয়, কেবল ভারতবর্ষের নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ কবি।” (বৈষ্ণবীর নিবন্ধ, পৃঃ-২২)
আমার মনে হয় ব্রজবুলি শব্দের মৌলিক অর্থ হইল— পথ চলা পথিকদের ভাষা। কথাটা এসেছে, ‘ব্রজ্' ধাতু থেকে যার মৌলিক অর্থ হল ভ্রমণ, অর্থাৎ ব্রাজক বা পরিব্রাজকের ভাষাই হল ব্রজবুলি। শব্দটিকে একটু নাড়াচড়া করলেই দেখা যাবে এটি হল একটি যৌগিক শব্দ, সম্ভবত ‘ব্র’ এবং ‘জ’ মিলিয়া ইহার উৎপত্তি। ‘ব্র’ অর্থাৎ বার (বৃ) বা বাহির (বহিঃ) এবং ‘জ’ অর্থাৎ যাওয়া (গম্)— এক কথায় বাহিরে যাওয়া বা গৃহের বাহিরে যাওয়া। “বনং ব্রজেৎ ”— কথাটির অর্থ তখনই ধরা পড়ে অর্থাৎ Go out to the forest. পূর্ব ভারতে মধ্যযুগের লিঙ্গুয়া ফ্রাঙ্কা ছিল ব্রজবুলি বা বহিযাত্রীর বুলি। কিন্তু বৈষ্ণব পদকর্তাদের দ্বারা বিষয়ের খাতিরে ব্রজবুলি বিস্তার লাভ করল। ধীরে ধীরে তা সাহিত্যের ভাষা ও আন্ত্যপ্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তর হতে শুরু করল ।
যতদূর সম্ভব স্বালঙ্কারে সজ্জিত করে শব্দালঙ্কার ও অর্থালঙ্কারের সংস্কৃত পজ্ঝটিকা বা প্রাকৃত পাদাকুলক ছন্দকে বেশি পরিমাণ অনুসরণ করতে শুরু করল। কিন্তু ছন্দের ব্যাকরণ ব্রজবুলি যথাযথ অনুকরণ করিতে পারল না। তার কারণ হল, এই অঞ্চলের মানুষের উচ্চারণে ছিল কোল ভাষা গোষ্ঠীর syllabic tendency বা দলমাত্রিক টান। এক কথায় যুক্ত ব্যাঞ্জনকে ভেঙে উচ্চারণের ধারা। যার ফলে দীর্ঘ স্বর অনেক ক্ষেত্রে দুই মাত্রার জন্য ছন্দে ঠোক্কর খাওয়া স্বাভাবিক হয়ে উঠেছিল— কখনও কখনও আবার একমাত্রার সঙ্গেও চলাচল করত। তাই ব্রজবুলিতে প্রাচীন ছন্দ ব্যবহৃত হলেও তা প্রত্নকলাবৃত্তের (Proto-moric) ব্যাকরণসম্মত নয়, ব্যাকরণ অনুসরণ করে তার চলার খুব গরজ কুড়মিরা কখনোই অনুভবই করেনি। অন্য দিক দিয়ে ভাবলে এও বলা আধিক্য হবে না যে- এর গঠনগত আদলও তার বিশেষ ক্ষমতার বাইরে ছিল। আচার্য সুকুমার সেন ব্রজবুলি প্রসঙ্গে ঠিকই বলেছেন “সে কেবল রসহীন শুষ্কপত্রের মর্মর।”
আবার নাগপুরি বা সাদরি(অপভ্রংশ কুড়মালি) ভাষার স্বাভাবিক গড়ন কিন্তু ব্রজবুলির খুবই কাছাকাছি। এখানে দু-একটি ঝুম্যইর বা সঁহরাই গানের দৃষ্টান্তই যথেষ্ট। এই সমস্ত ঝুম্যইর ঝাড়খণ্ড অঞ্চলের কোথাও কোথাও বিশেষত রাঁচির গৌতমধারা অঞ্চলে ভাদরিয়া গীত নামে পরিচিত।
"সবুমাসে সবু পরব ফিরি ফিরি আওত
মানুষ মরিলে নাহি আসে।
গাঁয়েকেরি আওন, বনেকেরই কাঠ
খসি খসি পড়ত আঙ্গরা ।।"
(লোধাশুলিতে সংগৃহীত, ১৯৭০।।তথ্যঋণঃ ডঃ সুহৃদ কুমার ভৌমিক)
পুরখেনি সঁহরাই((এই গীতগুলি কথোপকথনরত/প্রশ্নোত্তর ভাবে গাওয়া হয়ে থেকে। ★=প্রশ্ন ও ★★= উত্তর)) কয়েকটি গীতের নমুনা রইল--
★অহিরে কতি ধুরে আহউ ভালা তরঅ বাপু রে বাবু হউ কতি ধুরে আহউ তরঅ মাঞ।
কতি ধুরে আহউ বাঁদনা পরব ভালা ঘারে ঘারে গেইআ রে জাগাই ।।
★★অহিরে কুলহিক পিঁঢ়াঞ আহে ভালা মরঅ বাপু রে বাবু হোউ
ঘারে ত আহি মরঅ মাঞ। গাঁউএহি আহেক বাঁদনা পরব
ভালা ঘারে ঘারে গেইআ রে জাগাই ।।
★অহিরে কিআ কিআ খাউঅত মরঅ বাপু রে বাবু হউ
কিআ খাউঅত মরঅ মাঞ
কিআ দেইএ পুজবঅ বাঁদনা পরব ভালা ঘারে ঘারে গেইআ রে জাগাই ।।
★★অহিরে দুধভাত খাউঅত মরঅ বাপু রে বাবু হউ
ডাইল ভাত খাউঅত মরঅ মাঞ।
দুবা ধানে পুজবঅ বাঁদনা পরব ভালা
ঘারে ঘারে গেইআ রে জাগাই ।।
★অহিরে খজা খজইতে গেলা পঁছা পঁছইতে গেলা রে বাবু হউ
অহিরাকা ঘারা কতি ধুর।
অহিরাকা ঘারে আহি সিরমনি গেইআ ভাই
আউলিঅ গেইআ রে জাগাই ।।
★★অহিরে নেহি জে আইঅ হামে ভাতেকেরি লভে রে বাবু হউ
নেহি লাগই পিঠাকেরি লভ।
তহর ঘারে আহউ সিরমনি গেইআ ভাই
তাকর লাগি ত জাগাই ।।
★★অহিরে আজুকা রাতি ভালা বড় জগেক রাতি রে বাবু হউ
জাই হেতউ দুআইরে দুআইর । নেহি জে গেলে অহিরা বাখান পাড়তউ হউ
গাইরে সাঁপে নি বাঁচই ছইঅ মাস ।।
তথ্যঋণঃ ডঃ সুহৃদ কুমার ভৌমিক।। সমভুনাথ বঁসরিআর-সকতিপদ বঁসরিআর