আহাম্মকের গদ্য(তেইশ)"জন্মান্তের গান"

 আহাম্মকের গদ্য(তেইশ)



জন্মান্তের গান

যে রেস্তোরাঁতে আজ গিয়েছিলাম মানে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তার সম্পর্কে বলতে গেলেই আঁধারের চাপ এসে লুটিয়ে পড়ে। রেস্তোরাঁটির গঠনগত ও চারিত্রিক বিশেষ বৈশিষ্ট্য অন্যরকম। গোটা দেওয়াল জুড়ে পুরোনো বাংলা ছায়াছবির লিজেন্টের বিশেষ মুহূর্তের ছবি ফ্রেমে এঁটে সাজানো। মনে হবে ছোট ব্যালার স্মৃতি ভীড় করে আসে বারবার। বহু কথা মনে পড়ছিল। এর জন্য ওই ছবিগুলি যতটা না দায়ী তার চেয়ে ঢের বেশি দায়ী ভেতরের পরিবেশ ও তার সাপেক্ষে চলা পুরোনো দিনের বাংলা গানগুলি। ডিম আলোয় মনটা ন্যূব্জ হয়ে আসছিল। মনে হচ্ছিল পায়ের তলায় শিরশির করে হেঁটে যাচ্ছে আমার চিরপরিচিত এক শীর্ণতোয়া। যার কাকচক্ষু জল আর চিকচিকে সবুজ শ্যাওলার পাথরে লুটিয়ে নেমে আসছে শাওন। কি মন খারাপ যে লাগছিল! কিন্তু এই অসুখের একটা তীব্র টান রয়ে যায়। একটা রিনরিনে সুর! যখন বেজে ওঠে --


"মধু মালতি ডাকে আয়

ফুল ফাগুনের এ খ্যালায়"


এই গানগুলো শুনলেই মনে হয় একটা সময় এসে আটকে গ্যাছে আমার ঘিলুতে। অম্বল অম্বল অনুভব হয়। আমার ফি রবিবার জ্বর হবে, বাবা দাওয়ায় দড়ির খাটিয়ায় বসে রেডিওটার সেন্টার সরাতে সরাতে বেজে উঠবে এই গানটা। মা গেঁড়ির ঝোল আলু বেগুনের সাথে মিশিয়ে একটা মিহিন গন্ধ তুলে রান্না করতে করতে গুনগুন করবে- মধু মালতি ডাকে... আর আমি মায়ের বাতিল হওয়া নীল ডোরা শাড়ি দিয়ে সেলাই করা কাঁথাটিকে ডবল করে বিছানো আরেকটি খাটিয়ায় শুয়ে ভাবব-- "রেডিওতে এই গানগুলোয় চলে ক্যানো!!  মাঝে সাঝে এক আধটা হিন্দি গান চালালে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় বুঝি না!!"


      গানের 'গ' পর্যন্তও আমার দৌড় নেই। তবে একটা সুরের পরিবারে আমার মত অসুরেরও একসময় মনে হতে থাকে--

"মধু মালতি ডাকে আয়

ফুল ফাগুনের এ খ্যালায়"


আসলে গান একটা ছোঁয়াচে রোগের নাম। কানে যা বারবার পুনঃপুনঃ শ্রুত হয় তাই আমাদের ন্যস্টালজিয়ার ভেতর খাবি খেতে থাকে। এই প্রসঙ্গে সেই সময়ের টিভির একটি চ্যানেলের কথা মনে পড়ছে(যদিও অপশন আর তেমন কিছুই ছিল না ওটা বাদে) 'ডি.ডি বাংলা'। এখন হলে ওর উচ্চারণ রাজনৈতিক হয়ে যেত কি না জানা নেই তবে ওর দৌলতে কিছু অসাধারণ বাংলা সিনেমা গিলে ফেলেছিলাম একটা সময়। তাতে মাঝে মধ্যেই 'রেট্রোস্পেক্টিভ' চলত হপ্তা ভর। গাঁয়ে চট বিছিয়ে নামতা পড়া বাংলা মিডিয়ামের লগায় এই ইংরেজী শব্দটি না কুলোনোয় বেশ আশ্চর্য জনক ও চমকপ্রদ ঠেকেছিল বলেই বোধহয় মনে গেঁথে আছে আজও। তো, সেই সময় ক্লাসিক বাংলা সিনেমার সাথে ঠারে-ঠোরে পরিচয়। সব যে বুঝতাম বা ভালো লাগত এমনটা নয় তবে ওই যা পুনঃপুন শ্রুতিগোচর আর দৃষ্টিগোচর তাই একটা সময় ভালো লাগতে শুরু করে। আসলে ভালোলাগা আর অভ্যাসের সাথে আজও বাঙালি হয়তো পার্তক্য করে উঠতে পারিনি। এর নাম দেওয়া যেতেই পারে- "লং সাইট লাভ"। তবে আজ অবিশ্যি রুচি বা আলাদা কিছুর তাগিদেই এর অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজন অনুভব করি কিন্তু তখন সেটা ছিল পড়া ফাঁকি দেবার একটি বিচিত্র সোপান। কিন্তু ধীরে ধীরে যখন বুঝলাম এটাই আমার একমাত্র সহজলভ্য পাওনা তখন তার মধ্যেই আনন্দ, দুঃখ, খুশি, আবেগ, প্রেম, চর্যা সবই খুঁজতে শুরু করলাম, আর কি আশ্চর্য টপাটপ সব পেয়েও যেতে লাগলাম। অসফল গতির ভেতর যদি কেউ সফলতা আস্বাদ পেতে শুরু করে তখন সেই সাফল্যের কারণটিতে তার নেশা জমতে থাকে, অনেকটা লক্ষ্মীর ভাঁড়ের মত যা একসময় আমার মধ্যেও সঞ্চারিত হল। রাগ সঙ্গীতের আগাপাশতলা ঘোড়ার ডিম কিছুই বুঝি না তবুও শুনতে ভালো লাগতে লাগল। বাবা বলত-- "বোঝার দরকার নেই তো! ভালো লাগছে কিনা সেটাই আসল, বাকি সবই গৌণ। ব্যাকরণ নাই বা জানলি।" তবে এই ভালোলাগাটা অনেক নতুনত্ব ভাবনার ফুল ফল লতাপাতার জন্ম দিতে শুরু করল। দেখলাম ওমা!আমার নিজের কাজে অনেক বেশি একাগ্র করে তুলছে(আজও তোলে)। আর নতুন কৃষ্টির আচমকাই এক একটা দুয়ার 'চিচিংফাঁক' বলে খুলে যায় অবান্তর। তাতে কি সব যে বিচিত্র রত্নরাজি!!

      সে যাই হোক, তবে এর ফল কিন্তু খুব একটা স্বাস্থ্যকর হয়নি। বাবা অতি উৎসাহী হয়ে একপিস গন্ধমাদন প্রমান হারমোনিয়াম এনে গান শেখানোর চেষ্টা করেছিল বারকয়েক। কিন্তু বিচিত্র রকমের তালকানা হওয়ায় যে নমুনাটি বের হত তা তথৈবচঃ।  একবার তো পাড়া থেকে মিটিং করে এসে থামিয়ে গেছল। 'সে ইতিহাস গোপন থাকাই ভালো।' বাবা শ্রীখোলের ওস্তাদ মানুষ তার সুবাদেই টুকটাক শুনে শুনে জানা। সাত মাত্রার তেওড়া, পাঁচ মাত্রার ঝাপতাল। ত্রিতাল। দাদরা কিম্বা কাহারবা...

     বাবা শেষ বয়সে আর খোল ধরেনি। কেন ধরেনি জানি না হয়তো বা কোনও অভিমান থেকে হতে পারে তবে আমার জন্য কেনা সেই ঢাউস মার্কা হারমোনিয়াম বাজিয়ে গান করত প্রায়ই। গানটা আজও স্পষ্ট কানে বাজে-


"আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না

সেই জানারই সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা

আপনাকে এই জানা আমার..."


পরে তুলসিদাস পড়তে পড়তে মনে হয়েছিল সেই গাওয়ার সময় নিশ্চয়ই পাশে হয়তো তুলসিদাস বসে থাকতেন আর কানে কানে বলতেন--

          "জানত তুমৈ তুমৈ হো যায়"

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন--


Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.