আহাম্মকের গদ্য(বাইশ)
সাইকেলের ডানা(পর্ব-২)
পরবর্তী অংশ...
জীবন একটা অদ্ভুত টানেল। ঘুরপাক খেতে খেতে ঠিক এগোয়, আদপে এগোয় না পেছোয় সে বিদ্যে আর ইসকুলে আমাদের শেখা হয়নি। জীবন যাকে ছোট বলে দেগে দ্যায় সমাজ সেই দেগে দেওয়া ক্ষত বইতে থাকে নিশ্চুপে। সমাজ মানে তো আমি তুমি আর তারা। হাঁদুদাদার মত এই রকম অনেকেই জীবনে এসেছে দাগ টেনে দাগা দিয়ে ফুররররর....
"যে আলোয় দুহাতে মাখি কাদামাটি সে হাতে ছোঁওয়াও বারণ
যারা ছিল তারা ছিল
কেউ তো থাকে না আমার এই ডানায় পালকে
তুমি চেনো স্মৃতির গুহা আমি কি চিনি হে তোমায় বিপদতারণ"
দুর্দান্ত এক একটা বিকেল এসে আঙুল চেপে ধরে বলে-- চল, দেখবি! কি কি ফেলে এসেছিস আঁক দুয়ারের ওপারে!!
সকালকে তেমন ভাবে চেনা হয়নি। শুধু টিউশন ফসকানো "তাহাদের কথা" আড়মোড় ভাঙে। মনে হয় কত কথা কতজনকে বলা হয়নি। মধুমিতাকে বলা হয়নি-- 'তোর চুলের রিবন আমার সাইকেলে চলে এসেছিল।'
কিম্বা শ্রেয়াকে বলা হয়নি--'সাইকেলের ফুল রাখা পাব্লিকটিকে আমি যেমন চিনি তেমনই তুইও।'
সে সবই চকমকির আগুনের মত আসে কয়েকটা তীব্র ফুলকির মত। কিন্তু যারা অনেকক্ষণ জ্বলে তারা তাদের মধ্যে কেউ নয়। বৃহত্তর সমাজের যেমন থাকে একটা বৃহত্তর চৌকাঠ তেমনই আমাদের মত গেঁও মেঠোমাঠা শৈশব ও কৈশোরে থাকে ভানসিং ডাঙার হাড়হাবল্যাসের ডাহি। মেগে যেচে আনা একটা সাইকেল আর চালক প্রার্থী জনা সাত। একজন চালাবে আর বাকিরা তার পেছন পেছন ছুটবে। কিছু দূর গিয়ে তার দান শেষ, এরপর অন্যজন। এই ভাবেই সাইকেল পরিবর্তন হতে হতে দেখা যেত ছুটেছি বেশি চালিয়েছি নিতান্তই সামান্য। তবে এর মধ্যে একজনই ছিল ব্যতিক্রম। রেতৈ। সে সাইকেল চালাবে না। খালি পেছনে পেছনে ছুটবে, ওতেই ওর আনন্দ ওতেই তার মুক্তি। সে অবলীলায় কোটরে হাত ঢুকিয়ে বের করে আনবে পাহাড়ি টিয়ার বাচ্চা। তাদের বেঁহচি, দাহেড়দের গাছের পাকা পেয়ারা খাওয়াবে।জল খাওয়াবে। সারাদিন ওদের সাথে করে ঘুরবে কিন্তু সন্ধ্যের আগে কোটরে রেখে চলে আসবে আবার। অদ্ভুত নেশা তার। অদ্ভুত তার উড়ান। সেই রেতৈ সাইকেল তো চালাতই না এমন কি সাইকেলে বোসতও না পর্যন্ত। কিন্তু কি একটা মায়ায় জড়িয়ে পড়লাম আমরা। হাঁদুদাদা চলে যাওয়ার পর পরই একাকিত্বের সময় এসে বসত এই রেতৈ। পাশে বসে সেরেঞ গুনগুনাত। মাঝে মাঝে অপটু বাঁশি ফুঁকে "বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না", "রূপবান কন্যা"-র গান শোনাত। কথা তেমন বলত না বিশেষ। তবে কয়েকদিন পর থেকে ক্যামোন অস্বস্তি হতে শুরু করল। একটা সর্বক্ষণের চিরকূট যদি নিজের সাথে ঝুলে থাকে কাঁহাতক আর সহ্য হয়! আমি পালাতে শুরু করলাম সেই রেতৈ নামক আঠাটি থেকে। কিন্তু যতই পালাই ততই আরও বেশি করে চিপকে যেতে থাকে সেটি। যেখানে তাকে আশা করিনি সে সেখানেও হাজির হয়ে যায়। নিঃসঙ্গতা নিয়ে ডুংরির পাথরে বসে বসে মাছের খেলা দেখছি, আর ভাবছি না জানি কত রকমের মাছ আছে ঐ না শুকোনো পাথরের ঢঢ়াটিতে। এই অঞ্চলটিতে গাঁয়ের সচরাচর কেউ আসে না, একমাত্র কেউ মারা গেলে দাহের জন্য আনা হয়। গাঁ-টির শেষ প্রান্তে লম্বা লম্বা কয়েকটি প্রাচীন শাল গাছ, গোটা চারেক মহুল, কসৈ আর কুসুমগাছ নিয়ে গরাম থান। সেই গরাম থানের থেকে কিছুটা এগোলেই ডুংরিঢঢ়া। গুল্মপ্রকৃতির কাঁটা জাতীয়গাছেরই বেশি সমাবেশ যেমন শাঁওয়াকুল,বুদাকুল কয়েৎবেল জিলপিগাছ আরও অনেক। পাথরের ডুবকাটার উপরে উঠে দাঁড়ালে ডুলুং-র ক্লিশে শরীরের তামাটে বাঁকগুলো স্পষ্ট দেখা যায়। পাঁইড়কা বুঢ়িমওকাল আর ঝাঁকে ঝাঁক গুঁড়ুরের দল ছুটে যায় পায়ে পায়ে। দাদু বলে আগে নাকি এখানে সাহেবরা পাথরখাদান বানিয়ে ছিল। সে অনেককাল আগের কথা। তখনই গাঁয়ে এসেছিল এই রেতৈরা। খাদানে খাটতে। ওই উঁচু পাথরের পাশেই কিছু একটা বসানো ছিল। মেশিন হবে হয়তো। তার আশপাশটাও সানবাঁধানো। সে সময় নাকি বস্তা বস্তা গন্ধক আর বারুদ এনে পাথরের বুকে গর্ত করে বিস্ফোরণ করানো হত। বড় ডুংরি থেকে ঠিকরে পড়ত রাশি রাশি পাথরের টুকরো। সেই পাথর রেললাইনে বিছানো হত। অত্যন্ত উচ্চমানের গ্রানাইট।
নিঃসঙ্গতা নিয়ে সেই ডুংরির পাথর খাদানে বসে মাছের খেলা দেখছি হঠাৎ জলের ছায়ায় ভেসে উঠত রেতৈ। পেছন ফিরে দেখি যথারীতি মূর্তিমান দন্তবিকশিত করে আছেন। বলল- চ যাবি?
বললাম- কনঠে?
-- চ ন, লেইগব্য ত।
সে নিয়ে এসেছিল টুইনক্যা পেরিয়ে নদীর দক্ষিনে কয়েৎবেল বনের পাশ দিয়ে শালপাতড়ার বন। এর আগে এদিকটায় একবারও আসা হয়নি। দুজনে নদীর আৎড়ায় সাইকেলটি ঠ্যালা-টানা করে যে জায়গাটায় এসে থামলাম সেটি লম্বা শাল গাছের বনভূমির ভেতর ছোট্ট একটুরো ঘাসের গালিচা বিছানো মাঠ। দূরর থেকে শোঁ শোঁ করে হাওয়া ধেয়ে এলে মনে হয় মুহূর্তে হরিণের পাল লাফিয়ে চলে গ্যালো আমাদের। মনটা হঠাৎ বড্ড ভালো হয়ে গ্যালো। হাঁদুদাদা এই সময় থাকলে ঝুম্যৈর হাঁকাঞ উঠ্যথ--
"আ.হা কাঁশি ফুল বাতাসে উড়াব
আর তিরিংরিঙ্যা বাঁশরি বাজাব.."
মুহূর্তে আবার হাঁদুদাদার কথা মনে হতেই ঝিমম লেগে গ্যালো। রেতৈ বলল-- জান্যহ ব! গুরুবুঢ়া বলে "সৌব চল্যিঞ যায়, রহিঞ যাবেক ধুন।"
বলেই বাঁশিতে ফুঁ দিত-- সেই এক সুর, এক ঔদাত্য- যা ডানা ওয়ালা সাইকেলের পেছনে বসে থাকতে থাকতে একদিন কুসুমডাঙার পাড়ার ফেরত বা আরও কোন দূরর আলোর পথ পেরোতে পেরোতে শুনেছি বহুবার। আমি মৌনব্রত নিয়ে গামছা ঢেকে সাধের ঝিঁঝরা সাঁঢ়াটা কোলে নিয়ে কেরিয়ারে বসে আছি আর সেই সুর দিগ্বিদিক ঝাঁকিয়ে ঝাঁপিয়ে নেমে আসল শরাবনের ধারার মতন। শুধু এর কোনও ভাষা নেই, কথা নেই আছে শুধু ধুন... বাঁশরির ধুন...
আসলে ধুন আর কিছু না সুরেলা কাজের নাম বোধহয়
"মরম না জানে, মরম বাথানে, এমন আছয়ে যারা।
কাজ নাই সখি, তাদের কথায়, বাহিরে রহুন তারা।
আমার বাহির দুয়ারে কপাট লেগেছে – ভিতর দুয়ার খোলা।"