আহাম্মকের গদ্য (একুশ)
অ্যাংলো-সুইস ঘড়ি
বাবা যৌতুকে পেয়েছিল যে কটি জিনিস- তার মধ্যে বাঁশের আঁকশি ওয়ালা একটা কালো ছাতা, কুমিরের মত চাকড়া চাকড়া চামড়ার স্যুটকেস আর একটা ইয়াব্বড় ডায়েলের রূপোলি শরীর ওয়ালা অ্যাংলো সুইস ঘড়ি। বাবার দুটো জিনিসের ওপর আমার অমোঘ টান বহুকালের প্রথমটা ওই ঘড়ি আর দ্বিতীয়টা উত্তমকুমার টাইপ কালো ফ্রেমের চশমা। ওই চশমাটি আমি জ্ঞানত দেখে আসছি। দু একবার যে লুকিয়ে পরিনি তা নয় কিন্তু পরলেই ক্যামোন সিঙাড়ার ওপর ডুমো মাছি বসেছে মনে হত। ফলে এটা ভেবেই নিজের মনকে শান্ত্বনা দিতুম- "বাপু ওটা তোমায় মানাবে না"। আসলে কিছু কিছু জিনিস তৈরিই হয় বোধহয় কিছু কিছু বিশেষ বিশেষ মানুষের জন্য, কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল শালা আমার জন্য তেমন কিছু পার্টিকুলার জিনিস সৃষ্টি হয়নি বোধহয়, সের্ফ এই কিম্ভুতকিমাকার ধাঁচাটি ছাড়া।
বাবার কখনও শরীর খারাপ হতে দেখিনি। বাবা বলত "বাবাদের শরীর খারাপ হতে নেই তোরাও বাবা হবি একদিন, দেখবি আর শরীর খারাপ হচ্ছে না!!" বড় অবান্তর বাস্তব। সেই বাবারই যখন শরীর খারাপ হল তখন তাকে নিয়ে নানান জায়গায় ছুটছি। এত শক্ত হৃদয়ের মানুষের হৃদয়ের রোগ হয় কি করে!! যার মায়া দয়ার কোনও অস্তিত্ব কখনও লক্ষ্য করিনি-- বাবার সাথে হাঁটার সময় মধ্যমা এগিয়ে দিত, কিন্তু পরক্ষণেই ভিড় রাস্তায় নিয়ে গিয়ে হাত ঝাঁকিয়ে কাটখোট্টা স্বরে বলত - "নিজে নিজে হাঁট"।
সেই বাবাকে নিয়ে এ ডাক্তার সে ডাক্তার করছি, সেই সময় মোওকায় পেয়ে বললাম -- বাবাদের যে শরীর খারাপ হতে নেই তা এই বার কি বলবে?"
হাসতে হাসতে বলল-- "ওতো! বাবাদের হতে নেই আমি তো এখন ছেলে তোরা বড় হয়ে গেছিস"
বুঝতে পারলাম না আসলে মানুষ কতবছর বয়সে বড় হয়!! সেই সময়ও বাবার বাম হাতে বাঁধা থাকত তার সেই যৌতুকে পাওয়া অ্যাংলো-সুইস রূপোলি রঙা ঘড়িটা।
প্রতিদিন নানান কাজের মাঝে একটি অভ্রান্ত কাজ কখনো ফাঁকি দিতে দেখিনি, সেটি ওই ঘড়িটার দম দেওয়া আর রেডিও শুনে সময়টা মিলিয়ে নেওয়া। বোন জিজ্ঞেস করলে বলত- "এই যে ছোট ছোট কাঁটাগুলো দেখছিস! এই কাঁটায় সওয়ার হয়ে একদিন ভালো সময় আসবে।"
বোন বলত- "ভালো সময় মানে কি?"
-- "ভালো সময় মানে তোর মনের মত সময়, যা ভাববি সব হবে!"
---- "সৌব!! পাউরুটিও হবেক!"
সেকেন্ডের পিঠে মিনিট, মিনিটের পিঠে ঘন্টার কাঁটা চেপে এগোতে এগোতে একদিন আমরা বড় হলাম, বাবার হাত থেকে খুলে তার সাধের অ্যাংলো-সুইস ঘড়িটা আমার হাতে দিয়ে আই সি ইউ তে বাবাকে নিয়ে গেল, আমি ঘড়িটাকে প্রথমবার হকের জিনিস হিসেবে পেয়ে নেড়েচেড়ে দেখতে দেখতে তাকে বললাম-- "ভালো সময় কবে আসবে?"
বাবা সে বারের মত ছাড়া পেল। মুক্তি। ঘড়ি থেকে, সময় থেকে শরীর খারাপ থেকে, কিম্বা বাবা থেকেও।
ঘড়িটা রইল আমার হাতে, তবে বন্ধ।
কে জানে! কাঁটাগুলোও হয়তো তার মনিব চিনতো!!
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন--