আহাম্মকের গদ্য(সতেরো)
অন্ধকারের জন্ম কোনও একদিন
এখান থেকেই পথ দুইভাগ হয়ে গেছে গজদন্তের আদলে। রাস্তারও একটা সম্মোহনী গন্ধ থাকে, একটা ডাক, যেমন থাকে শরীরের চোরপথ। আদপে এটুকু বুঝেছি- 'শুরু বলে কিছু নেই, যেমন; শেষ মানে তখনও কিছু বাকি অথবা একটা বৃত্ত।' শূন্যও বলা যায়। এই পথ বহুদিন বৃষ্টি ছুঁয়ে দেখেনি। ফলতঃ মাখো মাখো ভাবটা হুস্..স।
পথটা এখান থেকেই দ্বিফলা হয়ে গেছে দুই উরুর মত। আজ মনে পড়ে একটা ডাইরি ছিল আমার একচিলতে নিকোনো উঠোন। সেথা মা ভুস-চুলহায় ধান সিঝাত সিঝাতে সিঝাতে... সময় সেদ্ধ করে ফেলত সেটা সে নিজেও জানতো না। সব কিছুরই মত সেও আজ ক্ষয়ে গেছে। কত পথ ইনিয়ে-বিনিয়ে এঁকেছে এই পা। কত পথ আজও শীতঘুমে...। এই লেখাটা যখন লিখছি তখন সন্ধে খেলে টেলে রাতের রানার নিয়েছে। রাতের টুকরো ছড়িয়েছে আনাচ কানাচ, আর জানালার বাইরে একটা বৃহৎ রাত্তির জুবুথুবু মেরে আছে। এখন আর শেয়াল কাঁদছে না ডুলুং-এর চরে। কতদিন কতদিন ক ত দি ন হিসেব ছাপিয়ে গেলে বুক। বড্ড মায়া নামে আজকাল। জানালার বাইরে... আলোর বাইরে..., এই চরাচরের বাইরে... রাতের ওপার থেকে কেউ গেয়ে ওঠে—
“যাও যাও যাও পায়রা কতই না ধূর যাবে রে
দ্যাখা হবেক চাকুইল্যা বাজারে।"
কোন তরুণী গাইলো বোধ হয়। কিন্তু কেন গাইলো এই গান। এমনতো কথা ছিল না তারও। করম তো ছুটি নিয়েছে বহুকাল; কতদিন কতদিন...ক ত দি ন... জানি না। হিসেব ছাপিয়ে গেলে বুক। জঙ্গলেরও একটা চোরা ডাক আছে। জঙ্গলেরও প্রসব যন্ত্রণা হয় আর এখান থকেই জন্ম হয়ে যায় কিছু আলুথালু কৈশোর। যেখান থেকে পথ দ্বিধা হয়ে চলে গেছে জুড়ুম ডুংরি হয়ে ডুলুং-র চর। আর অন্যটা ফুলপাহাড়ির বুক চিরে চলে গ্যাছে খড়িপাহড়ি হয়ে হলুদবনির দিকে, সেই অশ্বত্থ তলায় একে একে জমে উঠছে 'জাওয়া' যে ডাল নেমে গেছে আলতো! সেখানে কোনাকুনি ঝুলছে তিনটে হ্যাজাক। আবস্থায় কিছু গলো গলো পোর্ট্রেটের মুখ। সেদিনও সুখ পেতে পথ জেগেছিল। কিশোরী কোমরেরা তখন দুলে দুলে আঁকবাঁক আঁক বাঁক... আঁ ক বাঁ ক..। আঁধার মেশানো আলো আছড়াচ্ছিল বনকলমির ঝোপে। কত থোকা থোকা সুখ ঝুলেছিল সেদিন বল। তখনও বুঝেই উঠিনি এই 'জাওয়াগীত'-এই করম-এই আলতো নেমে যাওয়া ডুলুং-র জল শেষ হয়ে যাবে একদিন। আদতে হয়তো এই সত্যিটা সকলেই জানতো- 'শুরু বলে কিছু হয় না। যেমন শেষ মানে তখনও কিছু বাকি অথবা একটা বৃত্ত।' রুবেন খুড়ো তখন পঞ্চমে-
"ডহর ডহরে দাদা ডহর কত ধূর
ফুলপাহাড়ি মধুপুর দেশ আরও ধূর।।"
আর মাদল। তখন উদ্ভ্রান্ত প্রেমিক–তাং তাং তাং ধিতাং তাং... কিশোরী কোমরগুলো দুলে দুলে দুলে দুলে...দুলে দুলে.... আমি এখানে থাকি বটে তবে আমার বিশেষ বন্ধু নেই। আমি আর বিপ্লব। চারদিক মহুলে মহুল। ক'দিনের গরমটা ডোবালো বেশ। সকালের রোদও ফলার মত সরাসরি আঘাতে নামে। বৃষ্টি হবে হবে হয়েও হল না। থম মেরে আছে চারিদিক। আহা গো রাত, এমনিতেই ঘুম আসে না তার ওপর এই গরম। ঘেমে নেয়ে বিপ্লব এসেছিল, চা খায়নি। বিপ্লব তার কথা বলছিল সেদিন। তার সহিষ্ণুতার কথা, তার দ্বিফলা রাস্তার কথা, আর চোখের রঙের কথা। বিপ্লবকে বড় গোছগাছ লেগেছে এদিন। যা আদপেও ও নয়। আমরা দু-জনেই ভীষণ এলোমেলো। ওর জুতো জোড়া বলছিল সব পাল্টে যায় সব...সব...– এই সমাজ, সময়, ব্যক্তি, আমি, তুমি সব...। হ্যাঁ পাল্টে তো যায়ই যেমন ভাবে পাল্টে গেল এখানের রাত। ছা-পোষা হেঁয়ালি ঝোলে বাবলার ডালে। মিলিয়ে যাওয়া হাসির সারি, চাপাকান্না, উচ্ছন্ন ভয় আর নির্বাক হয়ে আসা অজস্র চালচিত্র উঠোন। মাঝে মাঝেই বাইকের চাকা রেখা বেয়ে যায় আদরের পথে। অনেকেরই জুতো হারিয়ে যায় রাতেই। কোথাও কোথাও নিশি ডাকে, কেউ কেউ নাকি ফেরেও শুনেছি। বিপ্লব কিন্তু আমাদের ছেলেবেলার কথা কিছুই বলেনি। সেই শেষ কথা। অথবা বিপ্লবও সে সত্যিটা জানত হয়ত যে—'শুরু বলে যেমন কিছু হয় না, তেমনই শেষ মানে তখনও কিছু বাকি অথবা একটা বৃত্ত।' কাঁটা চামচে তুললাম একটুকরো মেঘ তখন জল পেতে দিল হাওয়ার মজলিশ হাওয়া-মিঠাই রোদেরই বুদবুদ এই দ্যাখ কেমন উষ্ণতা ছুঁয়েছিল আঘাতের পেণ্ডুলাম! আসলে কাঁটা জানে না মার্জনা সংসার সরেন... মেঘ বলে পল্লবের সেরেঞ গাও দেখি বুধাই কাঁধের হাতলে বিভক্ত গাণ্ডীব আর ক্যাপসুলের তীব্রতায় শুয়ে থাক মন্থরভাষ। টুপ-টাপ-টুপ-টাপ গড়িয়ে পড়ছে সময়। তিরতির কেঁপে উঠল বাতি। জানালার বাইরে একটা দুটো নিশ্ছিদ্র অন্ধকার ঝিমোচ্ছে। জোনাকরা আজ সাঁঝতারা হলে মন ভালো হতো। দূরে কোথাও তারা খসল বুঝি! চোখ চাপা হলেই। বারবার ফিরে আসছে ডুংরির পাশে ছিটিয়ে থাকা বিপ্লবের এলোমেলো জুতো। ঠিক যতটা এলোমেলো সে নিজে। তার কিছুটা দূরেই ও। কাত হয়ে যাওয়া ঘাড় আর পাশ দিয়ে চলে গেছে একটা স্রোত ডুলুং-এর দিকে। নির্জন হয়ে গেছে পথ: ডুংরি, ডুলুং, অশ্বথতলা আর বাড়িদের চৌকাঠ। গুম মেরে আছে বাতাস। শুধু কিছু ভারী জুতো ঘোরাফেরা করে গেল সকালের রোদ কাঠি মেপে। গা গুলিয়ে ছিল খুব। ডুলুং-এর চরে ক্যারক্যাটা, তিতির, জলময়ূর সাবধানী ডানা মেলল তাদের। যেতে যেতে বৃত্ত হয়ে বিন্দু। রুবেন বুড়ো আর গায়নি তারপর, শুধু রাতের নাভী উপচে বনকলমির ভেতর থেকে শোনা যায়--
"ডহর ডহরে দাদা ডহর কত ধূর
ফুলপাহড়ি মধুপুর দেশ আরও ধূর।।"
এখানেই শেষ নয়; শুরুও না। আসলে শুরু বলে যেমন কিছু হয় না তেমনি শেষ মানে তখনও কিছু বাকি... পিঁপড়ের মত সার বেঁধে চলেছে অজস্র অবয়ব, মাথায় উচ্ছিষ্টের পোঁটলা। ওরা কারা! কোথায় চলে যায়! কোথায়...
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-
https://lekhajokha-ek-dasaker-goutam-mahato.blogspot.com/2022/06/ahammaker-godyo16.html