আহাম্মকের গদ্য(পনেরো) জার্নি-ফার্নি

 আহাম্মকের গদ্য(পনেরো)


জার্নি-ফার্নি



মাঝে অনেকটা সময় গলে গ্যাছে। ছাত্র জীবন কাটিয়ে আজকাল টিকে থাকার পৈঠায় মাঝে মাঝে পা দোলাতে দোলাতে ভাবি সৃষ্টি আর আকাঙ্খার যুযুধান বাস্তবের কথা, দেহাতি ঘিসাপিটা রুচির কথা আর ছিমছাম দর্শন বলয়ের কথা। এরই মাঝে হঠাৎ পুরোনো কিছু ফেলে আসা বন্ধুর স্মৃতির সুতোয় টান পড়তেই ধাঁ.. বর্ধমান বাইপাশ ছুঁয়ে যাওয়া। বাসটা নামাল যখন তখন ধকধক করছে মাথায় সূয্যি খুড়ো। এখানে শুনলাম বেশ যানজট যানজট খেলা চলে। হুগলি থেকে বাঁকুড়ামোড় হয়ে বর্ধমান আসার রুটটা তো আ হা বলাই বাহুল্য। শুনলাম কমপক্ষে ঘন্টা খানেক দামোদরের কৃষক সেতুতে আটকে না থাকলে বর্ধমান কি ঘুরলেন মোহাই। আবার সোনায় সোহাগা ওই 'সবে ধন নীলমনি' রুট আহাহা.. কি আনন্দ, কি আনন্দ...আকাশে বাতাসে।

      তো সে যাই হোক চু কিৎ কিৎ খেলতে খেলতে কন্ডাকটরবাবু যেখানে নামালেন সেই জায়গাটির নাম তেলিপুকুর। রাস্তাটির গা ঘ্যাঁসাঘেঁসি করে দাঁড়িয়ে উন্নয়নের টিপটপ ফ্লাইওভারটি। লাগোয়া কয়েকটা চা পান বিড়ির দোকান। দীর্ঘ জার্নির পর হালকা হাওয়ায় নেমে বেশ ফুরফুরে ফিল হচ্ছিল। আমার এই অগন্তব্য নিরুদ্দেশের রুটে মনে হচ্ছিল আহা কত্তদিন পর... সেই ছাত্তরজীবনে একবার এসেই বর্ধমানের প্রেমে পড়ে গেছলাম। আবার প্রায় দু যুগ পর সেই রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া ছাওয়া বীথি বীথি হাওয়া ছাওয়ায় অনেকটা হাঁটব। আচ্ছা সেই কার্জনগেটের লাগোয়া চা দোকানটির ভদ্রলোক কেমন আছেন! কৃষ্ণসায়রের গাছগুলো আমার পায়ের আহট চিনবে কিম্বা গলিরা গায়ের গন্ধ যদি একটিবার চেনে তবে বেশ হয়। কিন্তু নাহহ...কোনওটাই হল না জগ্গু বলল-- "গুরু, এ হল বর্ধমান। অর্থাৎ যার বর্ধনশীলতা দেখছিস তো! আগে দিনুকাকার ইটালিয়ান সেলুন ছিল, ইঁট পেতে চুল ছেটে বাটিছাঁট দিত তাপ্পর এলো সেলুন, পার্লার হয়ে এখন ঝাঁ চকচকে কেতাদুরস্ত স্যালঁ, হে হে হে হে হে বললে হবে বাওয়া বর্ধমান আমার কানে কানে মাঝে মাঝে বলে দ্যাখ আমি বাড়ছি মামু"

         ভুল ভাঙাটা শুরু হল হাতের চা-টা শেষ করে যেই ফ্লাইওভারের আণ্ডারপাস ক্রশ করে বাসস্ট্যাণ্ডে যাবার জন্য উল্টোপিঠে টোটো ধরব বলে এলাম। জাস্ট বোমকে গেলুম কাকা। ভাবতাম এ দৃশ্য বোধহয় ঝাড়গ্রামেই দ্যাখা যায়। প্রায় দেড়শ বছরের শালগাছগুলো যাঁরা আমার বাপ ঠাকুর্দা বা বড়বাপের মত ছায়া মেলে দাঁড়িয়ে ছিল তারা অ্যাকে অ্যাকে শুকিয়ে মরে গ্যালো আর সেই শালবীথি স্মৃতিতে রূপান্তরিত হল কয়েক দশকের মধ্যেই। দু একজন যে পোতিবাদ করে নি এমনটা নয়, সে শক্তি ঝাড়গাঁ অহরহ প্রডিউস করে তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু হঠাৎই তারা না জানি কোন নিশির ডাকে আত্মহননের পথ বেছে ন্যান, কে জানে। এখানেও নির্ঘাৎ তেমন কিছু নিশি পিসির আগমন নিতান্ত অমুলক হাইপোথিসিস নয় নিশ্চয়ই। এই তেলি পুকুরেই দেখলাম, আমি যেখানে দাঁড়িয়েছি সেটা আস্ত এখান শ্মশান। চারিদিকে অগনিত মৃতদেহ আর আমি কিছু যান্ত্রিক সাহচর্যে একা দাঁড়িয়ে। এক একটা মিনমিনে স্বর আমার অন্তরাত্মা থেকে জান্তব শরীর শিউরে তুলছে। কে যে ডুকরে কেঁদে উঠছে তার খবর বোধহয় জানে দামোদর থেকে ধেয়ে আসা মিহিন হাওয়ার গভীর। শুধু এটুকুই পার্থক্য- এখানে নৈঃশব্দের শান্তি নেই, হাওয়ায় শীতলতা নেই। মটির ঔদার্য্যে টান ধরেছে তনিক। শুধু আছে মুখ-চোখ ঝলসানো একটা অস্থিরতা আর টোটোওয়ালা বাসওয়ালাদের তীব্র কর্কশ যান্ত্রিক হামলানো। আর আছে নীরব গোটা পঞ্চাশেক মৃতশরীর আগলে বসে থাকা দু-চার গণ্ডা কাক-পক্ষী। মাঝে মাঝে অনুচ্চারে নিজের সাথে নিজের কথা হয়। জিজ্ঞেস করি আমার আমিকে-- তবে কি এও সেই শ্লো পয়েজেনিং? তবে কি খুন? নাকি কোনও অজানা মড়কের ঈঙ্গিত? চীনের সেই চড়ুই খুন যে কি মারাত্মক রূপ নিয়ে ছিল মনে পড়ে, বেরাদর?? মাথা থেকে কিলকিল কিলকিল করে গলে যেতে থেকে ঘিলুর পিণ্ডটা।

       চমকানো এখানেই শেষ নয়-- দেখলাম সারা বর্ধমান শহরের জি.টি রোড ধরে যে দু-ধারে প্রাচীন মোটাগুঁড়ির নিবিড় ছায়াঘন কৃষ্ণচূড়ারা ডালপালা ছড়িয়ে সুখ দুখের গপ্প করতে করতে বাসায় ফেরা পাখালিদের সাথে খুনসুটি করত তারা আজ কোন জাদুকরের হোগাস ফোগাসে গিলি গিলি ছুউউ... । তার বদলে লম্বা হয়ে পোয়াতি ময়ালের মত শুয়ে ঝাঁ চকচকে ডবল-লেনের কালো কালো দুটো রাস্তা, যাদের মুখ চোখ কিছুই ঠাহর হয় না। শুধু সাঁঝের নিয়ন আলো জ্বলে উঠলে ঝিকিয়ে ওঠে তার মিশমিশে শরীর। আমি জানি না এই রাস্তা আমাকে, জগ্গুকে বা বর্ধমানকে কোথায় কোন জাগতিক সীমার বাইরে নিয়ে যাবে একদিন, তার কথা নাইই বা বললাম।  আপনারও নাইবা জানলেন তাতে সেই সব মৃত গাছেদের দিব্যি, কারুর কিস্সু এসে যাবে না। বরং ফি রোববার মৌজ করে দ্বিপ্রাহরিক আহার সেরে ঢেকুর তুলতে তুলতে আমরা বেশ গান শুনবো--


  "আহা...  আগে কি সুন্দর দিন কাটাইতাম আমরা

         আগে কি সুন্দর..."


আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-

https://lekhajokha-ek-dasaker-goutam-mahato.blogspot.com/2022/06/ahammaker-godyo14.html

Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.