আহাম্মকের গদ্য (আট)[এগারোর পরবর্তী অংশ]

 

★★আহাম্মকের গদ্য (আট)★★

একটি আত্মজৈবনিক আখ্যান



 একঃ

আমি যেখানে পিঁড়ি পেতে আড্ডা মারি খেয়ালখুশি মত,সেটা একটা পৈঠাই তবে বাঁড়ুজ্জে বা হালদার বাড়ির কোনও পৈঠা নয় সরকারি ও বেসরকারির যৌথোদ্দোগের একটা নমুনা বলা চলে,আর যিনি আমাদের উষ্ণপানীয়ের যোগান সামলান তিনি আমার চৌদ্দকুলের কেউ নন অথচ তিনি আমার অতি আপন, আমাদের দিদি।জন্মসুত্রে বিহারের ছাপরা জেলার পূর্ববাসিন্দা।দেহাতি মৈথিলি তাঁর ভাষা।আমাদের সাথে গ্যাটিসমারা বাংলায় কথা বলেন,ছটের সময় ঠেকুয়া খাওয়ায়। বলে -"তনিক বৈঠলবা বাবু হাম দৌড়কে যাবে অউর দৌড়কে আওয়েলবা।"আর তারপরেই ফিরে আসে  হাতে ঠেকুয়ার মোড়ক নিয়ে।আমরাও ইহলোক পরলোক ভুলে অম্লানবদনে চিবোই সেই শুদ্ধ দেশি ঘিয়ে ভাজা অদ্ভুত সুস্বাদ।এই আমাদের ছোট্ট কাহন।এই আমাদের দিনান্ত যাপন।সেখানেই চা খেতে আসে মেঘাদা।কাকা(রাকেশ সিংহদেব); দেবুদা,চিন্টু,অমিতদা বা দেবাশিসদা আসতে দেরি হলে এই মেঘাদাই আমার স্টপগ্যাপ পার্টনার।

      আমি তরিণীখুড়ো বা তারানাথ তান্ত্রিক বহু দফায় পড়েছি কিন্তু এই সব চরিত্রের অস্তিত্ব যে সত্যিই আছে তা এই চলতা-ফিরতা মেঘাদাই প্রমান!  যদিও সত্যতা যাচাই-এর প্রয়োজন পড়েনি ঠিকই তবে অনেক প্রশ্ন আর উৎসাহ  মাথায় লাফিয়ে ওঠে কিন্তু সে সব ছাপিয়েও যে মহান পরাক্রমে সব তলিয়ে নিয়ে যায় সেটা তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা প্রবাহ, যাতে তরতাজা করে তোলে শিরদাঁড়ার রোমাঞ্চকর জীবন দর্শন ও অভিজ্ঞতার কিস্সা।

কোন এক অস্তিত্বহীন রাতে সে  ঘর ছেড়ে পালায়।তখন  সে ষোল(কিছু কম বা বেশি)। সে পালানো এক্কেবারে নির্ভেজাল।উত্তর পূর্ব নাকি দক্ষিন জানা নেই,ট্রেন বাস নাকি পয়দল তাও নিরর্থক, সে শুধু জানে হারাতে হবে।তা সে যে ভাবেই হোক। সে বলে-"জানো তো দোস্ত হারনোর একটা মদহৌসি আছে,যেটা সবাই বুঝবে না, আর যে বুঝবে! তাকে ধরে রাখা চালুনিতে জল ধরার সমান।" সে বলে চলে...

পালাতে পালাতে আমি ভিড়ে যাই জনা চার মেষপালকদের সাথে।চালচুলোহীন একটা বেসাহারা ছেলে যে তাদের রাতদিনের বেদর্দ সফরের সাথে মিলে মিশে যেতে থাকে ক্রমান্বয়ে। আমি তাদের ভেড়ার তত্ত্বাবধান করি, ফাইফরমাস খাটি, কোনও উদ্দেশ্য বিধেয় ছাড়াই,আমাকে তারাও বাজে অভ্যেসের মত আপন করে নেয়।সারাদিন ভেড়াদের পেছনে ঘোর, দেখভাল কর গোঠের,সাঁঝে  ডেরায় ফিরে লিট্টি বা খিচুড়ি খেয়ে পরের দিনের চারণ ভূমির অন্বেষনের অপেক্ষা করতে করতে ঘুম।সে নিশ্ছিন্ন ঘুম।এই রকম ভেড়ার পাল সাথে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বছর তিনেক পর  রাখামাইন্স ধলভুমগড় মৌভাণ্ডার হয়ে আমরা এসে ঠেকি দলমা টেরিটোরিতে।ঠাহর হয় না তবে স্টেশন থেকে প্রায় ৪০-৪৫ কি.মি ভেতরের এক গ্রাম।তার কোনও চিহ্নিত রাস্তা নেই। পায়ে হাঁটা দেড়ফুটের রাস্তা,দুধারে বনজ উদ্ভিদ। লতাপাতা,ফুল,আর লম্বা বৃক্ষরাজ তার বুক পেতে ছায়া নত করে রেখেছে দূরর দূরান্ত তক।মাঝে মাঝে বর্ষার পোয়াতি মেঘের ঝলক দেখা যায় কচ্চিদ কখনও,তবে সেও স্পষ্ট নয়।শ তিনেক ভেড়ার পাল সার বেঁধে চলেছে, হয়তো তারাও বুঝতে পেরেছে ততক্ষনে যে বাঁ দিকে ফুটখানেক হেরফের হলেই আশি নব্বই ফুট গভীরে।


           সন্ধ্যা হল যে গাঁয়ে তার চরিত্রের সাথে নামটিও বড্ড অদ্ভুত। লাইলেনবটা।এই গাঁ সভ্যতার বিকাশের অনেক আগের বলে মনে হতে পারে।প্রাগৈতিহাসিক যুগের বললে অত্যুক্তি হয় না। পাতায় ছাওয়া ঝুপড়ি, জোনাকি খচিত রাতের রত্নরাজি আর লম্বা চিৎ হয়ে পিছলে আসা পাহাড়ি ঝোরার জলজ শরীর।লন্ঠনের আলো ওখানে নাকি বাহুল্য।মনে করা কষ্টকর যে সেটা বিংশ শতাব্দী।তারা ডেরা ফেলল সেই গাঁয়েরই সীমান্তে।জল আনতে হয় জঙ্গলের ভেতরে বাঘুৎথান পেরিয়ে সেই ছোট্ট তিরতিরে ঝোরার ওপর দিক থেকে,এই অমৃতকুম্ভের সন্ধান দিল গাঁয়েরই জল আনতে যাওয়া জনাকয়েক রমনী।তাদের সাথে আমিও চললাম।পায়ে তাদের মোটা মলের গমক।আলতা পেড়ে হলদে শাড়ি তাদের পায়ের গোছ বা গোড়ালি ঢাকতে স্বক্ষমতা হারিয়েছে। জল আনতে যাওয়ার সময়ই মেয়ে বৌ-রা সাবধান করে দিল -- ডরনা নহী, বাবু হো! আর তুমি যাই দেখ এর পুনরাবৃত্তি মানা।পায়ে পায়ে যেতে যেতে তাদের সাথে আলাপ হল,ওদের ভাষা আদিম তবে বাইরের আদমি বলে আমার সাথে কথা হচ্ছিল দেহাতি হিন্দিতে ।ঝোরায় একে একে জল নিচ্ছিল তারা,আমিও জল নিতে গ্যালনটা সবে ডুবিয়েছি, একটা মুদু বুক্ বুক্ শব্দ তুলতেই শোনা গ্যালো এক গভীর হুংকার।এ হুংকার চিনতে জঙ্গলে বসবাস করতে হয় না,এ য্যানো সহজাত চেনা ধ্বনি।গ্যালন ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াই।মেরুদণ্ড বেয়ে প্রাচীন কোনও যুগ গড়িয়ে নেমে গ্যালো কোমরের দিকে।সে দেখে মেয়েগুলোর সেকি রিনরিনে হাসি।য্যানো সে এক বেজাই মস্করাকর কাণ্ড!

       ফিরতে ফিরতে ওরাই আস্বস্ত করে, ভয় পাও ক্যানো বাবু! বাঘুৎঠাকুর থাকতে ওরা ঝোরা ডিঙিয়ে এপারে কখনও আসেনি,আসবেও না।তবে রাতে একা বেরিও না নইলে কুঙরের মত হারিয়ে যাবে।কুঙর! সে আবার কে? আর তার মত হারিয়ে যাওয়ার মানেটা কি!কেউ কি কারুর মত করে হারাতে পারে নাকি! পরে পরে শুনেছি, কুঙর ওই গাঁয়েরই ছেলে।হারিয়ে গ্যাছে, বনে।বনের ছেলে বনে হারায় কি করে? এ এক বড় অদ্ভুত কথা! কিন্তু কুঙর কিভাবে ক্যানো যে হারিয়ে গ্যালো কেউ জানে না। হিসেবও মেলাতে পারে না।


      কয়েকটা দিন কাটতে, ধাতস্ত হওয়ার পর আমি সবকিছুর সাথে সম্পৃক্ত হতে থাকি একটু একটু করে।সেই ঝোরা সেই বাঘুৎথান, ঝিঁ ঝিঁ আর হুংকারের গুঁজ আমাকে ওদেরই একজন করে তুলছিল ক্রমশ। প্রায় রাতেই এরপর থেকে আমি ঝোরার ধারের পাথরে বসে চাঁদনি রাতে প্রেমিক হয়ে যাই।'হুঁড়ুর' তার দাওয়ায় বসে পাহাড়ি সেরেঞের ধূন টানে বাঁশির ছিলিমে।আর আমি নেশায় বিহ্বল হয়ে পড়ি একটা সময়।ভাবি অনেকদিন তো হল এদের সাথে আর না,পালাতে হবে.. পালাতে হবে..আর না।তখনই সেখানে রাত জুড়ে বেজে উঠত ঘুঙুরের রুনুকুঝুনুকু রুনঝুন রুনঝুন রুনঝুন।

     পরের সুবহায় হুঁড়ুরের কাছে জেনেছিলাম ও সব ময়ুরের গমনাগমন।তারা মানত করে তো!আর সেই মানত পূরণ হলে ময়ূরদের ঘুঙুর পরিয়ে ছেড়ে দিতে হয় বাঘুৎথানে।তারাই নাচে রাতে।আর বাঘুৎ ঠাকুর তাদের চরায় মায়াবি শিষে...



দুইঃ 


এমনই একদিন সকাল ফুরিয়ে আসতে আসতে   দক্ষিণের চড়াই উৎরায় সরাতে সরাতে পালালাম। কোথায় যাব কি জন্যই বা যাব ভাবিনি, য্যামোন ভেবে দেখিনি বাড়ি ছেড়ে পালানোর আগে..

  জঙ্গলের ক্ষয়ে যাওয়া মাটি নুড়ি পাথর মাড়াতে মাড়াতে পৌছলাম যেখানে সেটাকে আর জঙ্গল না বলে একটা ডুবকা বলা যেতে পারে। একটা সুবিস্তীর্ণ উপত্যকা মতন। জল খেয়েই কেটেছে দুপুর। কতরকমের যে বিচিত্র ঝোরা হয় তা বলে বোঝানো যাবে না, তবে এই জঙ্গল আমায় অনেক শিখিয়ে পড়িয়ে নিয়েছে এই 'ক'মাসে। হুঁড়ুর ছিলিম সাজাতে সাজাতে বলত যে জল বহে না, যে জলে কোনও জলকীট নেই সে জল বিষাক্ত। এ সবও তো গুরুসঙ্গের ফসল। আমার গুরু অনেক। যে যা পেয়েছি শিখেছি, আঁকড়ে ধরে ছিবড়ে করে শিখেছি। তারপর সেই শিক্ষা যখন নিয়ম নৈমিত্তিকতাকে ছুঁতে চেয়েছে আমি পালিয়েছি। সেখান থেকে সেই শিক্ষার খাঁচা থেকে। সর্বোপরি নিজের থেকেও। আবার নতুন মেঘা হয়েছি নিজেকে সম্পূর্ণ দিমড়ে মুচড়ে ভেঙে। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। আফসোস হয়নি কখনও। স্বাভাবিক স্বাচ্ছন্দ্য জীবন আমার গায়ে পায়ে না মাথা বুক খুঁটে খুঁটে খায়। জটিল ছায়া, বুনো কুড়চির ডাল আর ঝুনঝুনির ডাল সরাতে সরাতে কতদূর এসেছি ঠাহর হয় না।

     এখন বেলাডুবার কাল। খিদেরও সম্ভ্রান্ত উদয় হতে লাগল। দীর্ঘপথ ফেলে আসা সহজ ছিল না। কিন্তু একবারও ভাবতেও ইচ্ছে হল না গ্রামে বা পালের তাঁবুতে এখন কি হচ্ছে। যা ফেলে আসি তা ফেলেই আসা ভালো, ফেরার একটাই জায়গা হওয়া উচিত। তবুও তাতেই যে ফিরব ত্যামোন নিশ্চয়তাও নেই তবু...

এই 'তবু'  'যদি' এগুলোই তো মানুষকে দুর্বল করে। আমাকেও পারতো যদি না পালানোর বুদ্বুদ মাথায় বারবার উঠতো। এটা একবার দুবার নয় বরং বারবার মাথায় ওঠে আর তখনই কে য্যানো আমায় ডাকে। ইসারায়। উত্তরে নাকি দক্ষিণে, পূর্বে নাকি পশ্চিমে ঠাহর হয় না।

     যেখানে এখন আমি বসে আছি সেটি একটি কালো সানবাঁধানো ঘাটের মত চাট্টান। অনতিদূরে কিছু পাখপাখালি বাড়ি ফিরল বোধহয় কিচিরমিচির ভেসে আসছে। আর ভেসে আসছে বুনো হাতিদের বৃংহণ। কাছাকাছি আছে বোধহয় দলটা। বাতাস জানান দিয়ে গ্যালো ভ্যাপসা মেঠো সোঁদা গন্ধ। আমি চিনি এই ঐরাবতিক গন্ধ।তবে এর সাথে তবে এর সাথে মিশে আছে একটা পাহাড়িয়া ফ্লেভার। যা অন্য পরিচিতদের থেকে আলাদা করে। তবে ভয় ভয় করছে না আমার। জঙ্গল কারুর অহেতুক ক্ষতি করে না। কিন্তু ক্ষিদের ফানুসে হাওয়া ভরতে শুরু করলে সব বিক্ষিপ্ত হয়ে যায়। অস্থির লাগে। ভাবছি কি খাব! কোথায় পাব? আশা ছিল সাঁঝের আগেই ফিরে পাবো কোনও বসতি। কিন্তু দূরদূরান্ত তক কিছুই নজরে আসে না। হঠাৎ পেছন থেকে কে য্যানো একটা বিচিত্র শব্দে হাঁক দিল। আলো আঁধারি গাছের নিচে দাঁড়িয়ে এক দেহাতি কিশোর। আমায় হাতছানি দিতেই মন্ত্রসম্মোহিতের মত উঠে গেলাম তার দিকে। 

সে দেহাতি হিন্দি মিশিয়ে আমাকে জিজ্ঞেস করল -কে হো?

বললাম নিজের কথা, পালানোর কথা আর তারচেয়েও জোর দিলাম ক্ষিদের কথায়। সে শাল পাতার মোড়কটা এগিয়ে দিল। বলল -খা। দেখলাম তাতে কিছু বুদা খেজুর, বেঁহচি,ভুঁর্রু,কেঁদ আর পেয়ারা। তবে এই পেয়ারা একটু ছোট আর খয়েরি। কষা ও মিষ্টির সংমিশ্রিত তার স্বাদ। খেতে খেতে সে নানা প্রশ্ন করছিল। আমিও জবাব দিয়ে যাচ্ছি। হয়তো একাকিত্বের আঁধার মুছছিলাম দুজনেই। বললাম --কাছাকাছি কোনও গাঁ নেই?? 

বলল -- নাহহ। একটাই আছে যেটাতে তুই আর ফিরবি না। নাইলেনবঁটা। একটা গাঁ আছে তবে সেটা দু দিনের রাস্তা।

আমার অবাক লাগল কথাটা শুনে। 

বললাম-- তাহলে তুই থাকিস কোথায়?? নাইলেনবটায় তো তোকে দেখিনি কখনও? 

সেও ততোধিক উদাসীন ও সংক্ষেপে বলল -- কেন! বনে! 

বলে কি ছেলেটা এই নির্ভেজাল বনে একা থাকে! যেকোনও জনপদেই তো চাইলে যেতে পারে! অন্তত নাইলেনবঁটায়।

বললাম-- ক্যানো!

বলল -- আমি হরিয়ে গেছি তাই।

এই সময় কথাগুলো টিমটিম জোনাকি হয়ে জ্বলে উঠল, অপার স্নিগ্ধতা কথার শিরায় শিরায় শিশির হয়ে ঝরছিল য্যানো। আঁধারে আর মুখ দেখা যাচ্ছিল না কারুরই।

বললাম---সে তো আমিও হারিয়ে গেছি! তাহলে দুজনই এক বোঝার ঘাস, কি বলিস?

কথাটা বলেই হাসলাম মৃদু। সেও হাসল বোধহয়। 

-- না না তা তো নয়। তুই পালিয়েছিস আর আমি হারিয়েছি। দুটো একবোঝার হবে কোন দুঃখে!

বললাম -- ওই একই তো হল।

-- হারানোর মধ্যে ডুব আছে আর পালানোর মধ্যে ভেসে থাকার একটা তাগিদ, তোর ভেতরে কোথাও না যাওয়ার লক্ষ্য আছে, আছে ফেরার সুক্ষ্ম ডোর, তাই তুই ফেরারই(ফেরারি)। আমি সে সব কিছুর বাইরে ইহকাল পরকাল, আগামি, ভুত, ভবিষ্যতের, সবকিছুরই। আমার আছে বলতে বর্তমান। এই জঙ্গল, বুনোঘাস, লম্বা লম্বা পুরুষালি গাছ আর বুনোলতাপাতার নারীত্ব। তবে হ্যাঁ, দুটোর মধ্যেই একটা মাদকতা আছে। কোথাও গিয়ে হয়তো এক, নইলে আমার সাথে দেখাই বা হবে ক্যানো তোর!

বলেই উঠে দাঁড়ালো। চাঁদ উঠেছে জামবাটির মত।গোল। এখান থেকে চাঁদটা বড্ড নিখুঁত গোল দেখা যায়।

বলল--চ

বললাম --কোথায়?

-- চাঁদটা দেখছিস না! কাল ময়ূরডুবার হাট কাল বাইসামকে পৌঁছে যাব। এই তো এই ডুবকাটা পেরোলেই ওপাশে বুড়িমউকালের বন তার ওধারে হাট যাওয়ার রাস্তা। সেখান থেকে তুই অনেক গাঁয়ে যাওয়ার লোক পাবি।


       আমরা হাঁটিছিলাম চাঁদটাকে বামে রেখে। এক সময় সেও ঘোলাটে হয়ে এলো। ভোরের আলোয় বুড়িমোউকালের বন তখন ঝরঝরে সুন্দরী। কান পাতলে ঝিনিৎ ঝিনিৎ শব্দ হয়। ডান দিকে পাহাড়। বামে নেমে গ্যাছে হলুদ ঝোরা। পাথরগুলো তামাটে।মনে হয় সৃষ্টির পর থেকে এই পাথর কোনও মানুষের ছোঁয়া পায়নি। হাতে মুখে শীতল জলের ঝাপটা দিয়ে সকালের হাওয়ায় বসলাম দুজন। সে আমার দিকে চেয়ে মিটমিট করে হাসছে.. কিছু বলবার আগেই বলল -- চ, নাহলে দেরি হয়ে যাবে।

   বুনো গন্ধটা বারবার নাকে আসছিল। এ গন্ধ আমা চিনি না। তবে এই গন্ধে বিমর্ষতা আছে। সে বলল-- দিন কয়েক আগে এদিকটায় আগুন লেগেছিল, এই গন্ধ সেই মৃত গাছগাছালির। কান পাত শুনতে পাবি মৃত লতাপাতা আর গাছের স্বজন হারানোর গোঁঙানি। 

তার স্বরেও নেমে আসছে মেঘ। বর্ষা নামার আগে যেমন ভ্যাপসানি নিস্কর্মা করে দ্যায় তেমনই আলস্য আমার দিকে ছুটে আসছিল। পাতার মচমচ শব্দটুকুই শুধু জানান দিচ্ছিল আমরা কোনও এক নিস্তব্ধতার পৃথিবী দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি।কিন্তু কোথায় যাচ্ছি ক্যানোই বা যাচ্ছি সে সবই অমূলক, উচ্ছিষ্ট মাত্র। বাইসাম বেলায় আমাকে তর্জনি নাচিয়ে যা দেখালো সেটা একটা বিক্ষিপ্ত মিছিল, দূরর থেকে কালো কালো ভোমরার মত কিছু লোকের রেখা মাত্র। ছেলেটি বলল -- যাহ.. পালা..

সে স্বর অভিমানের নাকি আনন্দ বা বিষাদের বুঝতে পারলাম না!

বললাম --তুই কোথায় যাবি?

-- আমি! হারিয়ে যাব! এই প্রাচীনতা এত দৌলত এত আনন্দ আর বুড়িমউকালের মত কত কত কোল পাতা আছে আমার জন্য, জানিস?


বললাম -- তোর নামটা তো বললি না??

পেছন ফিরে যেতে যেতে চিৎকার করে বলল--


 --কুঙর...


"বন গয়ী হর মর্জ কী দাবা অ্যাই সাহিল

এক ইসক্ হ্যায় জো আভি ভী লা ইলাজ হ্যায়"





আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন-


https://lekhajokha-ek-dasaker-goutam-mahato.blogspot.com/2021/05/ahammoker-godyo.html


Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.