রহৈন পরব
রহৈন ফল
"বারঅ দিনে বারনি তের দিনে রহনি
দে ন দাদা ঠেঙা কাটিঞ, বহু জাতেক বাগালি।।"
অনেকে মনে করেন রহৈন শব্দটি এসেছে রোহিনী নক্ষত্র থেকে। অর্থাৎ রোহিনী নক্ষত্রের বিশেষ অবস্থানের জন্য (জৈষ্ঠ্য) ধরৈন মাসের ১৩ তারিখই রহৈন পরব শুরু হয়।
কোনও কোনও বুঢ়া পুরখাদের মতে-- রহ্(রাখা/থাকা/ সংরক্ষণ) > ঐন্(শুরু/প্রারম্ভিক)। অর্থাৎ রহৈন হল ধারন করে রাখার এক প্রারম্ভিক সময়ের উদ্যাপন। এই সময় বীজ ধান পরীক্ষা করে সংরক্ষিত বা গচ্ছিত করে রাখার যে প্রথা তা-ই রহৈন।
কেউ কেউ বলেন শুধু তাই নয় রহ্>নতুন জীবনের সঞ্চার যে সময় হয় সেটাই রহৈন। তবে লক্ষণীয় রহ্ ও রূহ(ফারসি) দুটোই প্রায় সমার্থক। হতে পারে প্রাচীন কালে কুড়মিদের সংস্পর্শে আশায় এমন অষ্ট্রিক শব্দ ফারসি শব্দ ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে।
ধরৈন মাসটি ধারনের প্রাচীন রূপ, হতে পারে ধৃ ধাতুটিও এই ধরৈন শব্দের দান। ধরৈন অর্থাৎ যে মাসে ধারণ(যে কোনও জড় আধার থেকে জীবন উন্মেষ) হয়। তাই কৃষিজীবি আদিবাসীদের জন্য এই ধরৈন মাসটি হল প্রাণ প্রতিষ্ঠা ও জীবন সঞ্চারের সময়। রহৈন সময়।
প্রাকদ্রাবিড়ীয় টোটেমিক মানুষজন ও তাদের ট্যাবু যেমন এই মাটিকে সমৃদ্ধ করেছে তেমনই সমৃদ্ধ করেছে এদের ভাষা ওসংস্কৃতিচর্চার ইতিহাসও। আদিবাসী কুড়মি সম্প্রদায়ের আগের (লেখায় বলেছি) সত্যিই বারো মাসে তের পার্বণ। তার আরও একটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে আজ। রহৈন পরব। সারা চুটিয়া নাগপুর তথা ভঞ্জভূমের অধিকাংশ অঞ্চলেই এই পরবটি মহাধুমধামে অন্তর থেকে পালিত করেন এই সম্প্রদায়ের মানুষজন।
কি এই রহৈন পরব!! আসুন, সামান্য পরিচয় করিয়ে দিই এর সম্পর্কে। জেনে নেওয়া যাক কিই বা এর নেগ-নেগাচার(নিয়ম কানুন ও পুজা পদ্ধতি)!
★রহৈনঃ--
এই রহৈন বাংলা ক্যালেন্ডারের হিসেবে ১৩ই জ্যৈষ্ঠ্য অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানটির ব্যাপ্তিকাল সবচেয়ে বড়। তাই অনুষ্ঠানটি কয়েকটি পর্যায়ে ভাগ করা যেতে পারে। ‘বার অহনি’ যা ১২ই জ্যৈষ্ঠ্য ‘বার’ বা প্রস্তুতির দিন এবং ১৩ই জ্যৈষ্ঠ্য ‘রহৈন’ দিন। এরপর থেকে এই রহৈন উৎসব চলে এক সপ্তাহ জুড়ে। ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠেই দিনাদি কর্ম না করেই গোবর দিয়ে ঘরের সীমানানুযায়ী দেওয়ালে বেড়ি টানতে হয় (রেখা টানা)। প্রবেশ দরজার দু-পাশের দেওয়ালে গোবরের সূর্য এঁকে তার উপর ৫/৭টি সিঁদুরের তিলক টেনে দেওয়া হয়, ধারণা অশুভ/কু দৃষ্টি থেকে রক্ষা করে এই চিত্রিত যন্ত্র, ফলে ঘর বা গৃহস্থের কোন রকমের অকল্যাণ নেমে আসে না। তারপর আকাশ আর একটু পরিস্কার হলে ঘরদোর উঠোন খামার পরিস্কার করে গোবর লরানো হয় (গোবর লেপা)। এরপর প্রবেশদ্বারে ও তুলসী থানে, চৌকাঠে, খামারে, চালের গুঁড়ি গুলে চৌখপুরা দেওয়া হয়। বেলা বাড়লে বীজধান বেছে রাখেন বাড়ীর মহিলারা। সন্ধ্যার মুখে গৃহকর্তা সম্পূর্ণ শুদ্ধ হয়ে ধুতি পরে নতুন টোঁকায় (বাঁশের তৈরি ঝুড়ি) করে নির্বাচিত বীজধানগুলি নিয়ে নিজের জমিতে ‘আখ্যাইন যাত্রা’-র দিন যেখানে হাল পুইন্যাহ্ (কুড়মালিতে এর অর্থ হল প্রথমিক শুভারম্ভ) করেছিলেন সেখানকার মাটিতে প্রতীকি বীজবপন করে। একে বলা হয় ধানমুইঠ্যা। একমুঠোতে যত ধান উঠবে তা দিয়েই জমির উর্বতা পরীক্ষার জন্য এটা চাষের প্রাক প্রতীকী মাত্র।(ধানের মুইঠ্য/অঙ্কুর বের করা হয় বলে এর নাম ধানমুইঠ্যা)ফিরে এসে বাড়ির সকলের সাথে রহৈন ফল, রহৈন পিঠা ও রহৈন মাটি ভক্ষন করে। তাদের বিশ্বাস এই মাটি তাদের মা, আর এই মাটি পচন নিবারক। রহৈন ফল বিষক্ষয়ী প্রতিষেধকের কাজ করে। এই উৎসবে মেয়েরাও বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এই রহৈনদিনের প্রখর দাবদাহকে উপেক্ষা করে কৈশোরে উপনিত হওয়া সব ছেলেপুলেরা ঘোরদোর পরিস্কারের কালিঝুলি, ধুলোবালি কাদামাটি সারা গায়ে মাথায় মেখে মনের খুশিতে বিচিত্র সেজে “রহৈন খেলায়” মেতে উঠে। ঘরের উঠোনে উঠোনে মাদৈল ধমসার তালে তালে অঙ্গভঙ্গী, ডিগবাজি, নানান শারীরিক কসরত, নাচখেল ও আদপ কায়দা পারফর্ম করে। তবে এই কেরামতিগুলি বিশেষ ভাবে লক্ষণীয়, কারণ এই সবের ভেতরেও থাকে কঠোর পরিশ্রম ও শৃঙ্খলার ছাপ, যাকে কোনও কোনও বিশেষজ্ঞ "part of martial art" বলেও উল্লেখ করেছেন।
“বার দিনে বারনি
তের দিনে রহনি,
চালচিড়া পইসা দে
নাঞ দিবিস ত জবাব দে।
হাবুডাবু খেইলব নাঞ
নাঞ দিলে যাব নাঞ।”
ইত্যাদি নানান গান গেয়ে নাচতে নাচতে কচিকাচারা সন্ধ্যা পর্যন্ত সারা গ্রাম থেকে চিড়ে, মুড়ি, চাল, পয়সা, সরিষার তেল ইত্যাদি সংগ্রহ করে সন্ধ্যায় তা দিয়ে হৈ হৈ করে মহাড়ম্বরে সাধ্যনুসারে চড়ুইভাতির মত কিছু আয়োজন করে নিজেরাই। সূর্য সামান্য ঝুঁকে এলে বেলা পড়ে তখন মেয়েদের “রহইন মাটি” সংগ্রহের অনুষ্ঠান। মূলতঃ অনূঢ়া মেয়েদের দ্বারা কোন তৈরি জমি থেকে “রহইন মাটি” সংগ্রহ করে। আসলে কুড়মিদের বিশ্বাস কর্ষিত জমির উর্বরতা সৃষ্টির আদি শক্তির প্রতিক। পরে বীজ বোনার সময় প্রতি জমির জন্য বীজের সাথে ওই “রহইন মাটি” মিশিয়ে বোনা হয়ে থাকে। ওই মাটি সংগ্রহের সময় মেয়েরা মুখে 'রা' না করে অর্থাৎ সম্পূর্ন মৌনতা অবলম্বন করে, একাগ্র মনে কোনও দিকে না তাকিয়ে মাথা নীচু করে পথ চলতে থাকে। তাদের একাগ্রতা ভঙ্গ করার জন্য রহইন খেলা শিশু কিশোর বাহিনী রাস্তায় বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করতে শুরু করে দেয়। কোন সময় সামান্য নিয়মের বিচ্যুতি হলে পুনরায় ওই মাটি সংগ্রহ করে আনতে হয়। তাই কোন কিছুতেই বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে কিশোরী মেয়েরা অত্যন্ত একাগ্রতার সাথে নতুন বাঁশের “টুকি” তে শেওড়া ইত্যাদি ডালপালা ঢাকা দিয়ে রহইন মাটি সংগ্রহ করে এবং তা ভুত পিঁড়ার উপরে বা পাশে সযত্নে সারা বছরের জন্য রেখে দেয়। সন্ধ্যায় বাড়ির সকলে একত্রে জড়ো হলে আষাড়ি ফল টুকরো টুকরো করে প্রত্যেকে খেয়ে থাকে। ধারনা, ওই ফল খেলে বিষাক্ত কীটপতঙ্গ, সাপ ইত্যাদিতে কাটলে শরীরে বিষক্রিয়া সহজে অতটা মারাত্মক হতে পারে না। অনেকটা প্রতিষেধকের মতো কাজ করে। তারপর রাত্রে মাংস ভাত, আইসকা পিঠা ইত্যাদি খাওয়া দাওয়া হয়। কোন কোন গ্রামে ওই দিন রাত্রে আয়োজন করা হয় ছৌনাচ, ঝুমুরগান, মনসামঙ্গল ইত্যাদি। এই ভাবেই সমগ্র ছোটনাগপুর এলাকা জুড়ে পালিত হয় “রহইন / রহিন পরব” বা “ধুলা পরব”।
তারা বিকেলে রহৈন মাটি সংগ্রহ করে এনে খামার গোয়াল সহ নানা জায়গায় রেখে দেয় আর বীজধানে মিশিয়ে দেয়। আর এই রহৈন মাটি যে টুপাতে (বাঁশের তৈরি ছোট ঝুড়ি) করে আনা হয় সেটিরও বিশেষত্ব লক্ষণীয়। এই টুপাটিকে সিঁদুর মাখিয়ে বরণ করে নেওয়া হয় তারপর তাতে লোহার পেরেক বিঁধিয়ে দেওয়ার রীতি। যাতে অন্য কারোর নজর বা কু-দৃষ্টি না পড়ে।
এর এক সপ্তাহ পর থেকে অর্থাৎ ২০শে জ্যৈষ্ঠ্য থেকে সাতদিন চলে বিশ্রাম পর্ব। যাকে বলা হয় ‘ডাহা/ডাহ্। ডাহ্ অর্থাৎ বিশ্রাম, এই সাতদিন সাত ধরনের প্রতিষেধক নিয়ে(আম,জাম,নিম... পিত্থিম্) ভক্ষণ/লেপন করে শরীরকে কৃষিকাজের উপযুক্ত করে তুলতেই এই ডাহ্ অত্যন্ত কার্যকরী। এই আম ডাহ্ মানে হল দুপুর থেকে আম ভক্ষণ পূর্বক পুরো দিন অতিবাহিত করতে হবে। এই ভাবেই সাতদিন উক্ত ও নির্দিষ্ট বস্তু ভক্ষণ/লেপনের মাধম্যে শরীরকেও ক্ষেতের মতই প্রস্তুত করে তোলার কৌশলই হল ডাহ্। এই প্রসঙ্গে বলে রাখতেই হয়-- এই ডাহ্গুলি নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট খাদ্য/লেপন বস্তু খাওয়া/ লেপন করা জরুরী তবে আগের ডাহ্ গুলিও ক্রমানুসারে ভক্ষণ ও লেপন জরুরী। যেমন-
আমডাহ্ তে শুধু আমই খাবে
কিন্তু জামডাহ্ তে আম+ জাম দুটোই খাবে
.....
শেষে যখন অগ্নিডাহ্তে এসে(আম+জাম+কচড়া+হলৈদ(হলুদ)+নিম+পিত্থিম (মাটি লেপন ও সামান্য ভক্ষণ)+আগুনে/রোদ্রে এনে শরীরকে উপযুক্ত করে তুলবে।
এই ডাহ্/‘ডাহা’ এর সময়পর্ব দুপুর থেকে। তার আগে একদিন অর্থাৎ সকাল থেকে দুপুর অবধি চলে মাঙ্গন। এই ডাহা বা ডাহ সাত দিনের সাতটি, আমডাহ্, জামডাহ্, ★(কচড়া) মিরগিডাহ্, ★(হলৈদ) নিরবিসডাহ্, নিমডাহ্, পৃত্থিমীডাহ্, অগ্নিডাহ্। আর এই মাঙ্গন হল সময়ের যাচ্ঞা। অতিরিক্ত সময় চাওয়া বা প্রার্থনা করা। এর পরের সপ্তাহ অর্থাৎ ২৬শে জ্যৈষ্ঠ্য থেকে শুরু হয় ‘কোৎকাহ ই’ বা ক্ষেতকী। ক্ষেতকী পাঁচদিনের--(১)দাঁতগিজড়া,(২)হাইভাত,(৩)কুহুভাত,(৪)সুরুমইনা,(৫)হাইসুইননা।
এই ক্ষেতকী শব্দটি পরে ক্ষেতকারী শব্দে রূপান্তরিত হয়। উক্ত সময়কালটি ক্ষেত প্রস্তুতের জন্য সুবর্ণ সময় [কথিত আছে এই দাঁতগিজড়ার দিন জনাহ্ইর(জনার/ভুট্টা) বোনা বারণ, কারণ ফলন আশানুরূপ হয় না], কারণ এর ক'দিন পর থেকেই আষাঢ় মাসের সূচনা অর্থাৎ বর্ষার সমাগম। তাই এই দৈনন্দিন কাজটিও হয় প্রথা মেনে বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির আধারে ও উৎসব উদ্যাপনের মাধ্যমে, সানন্দে। এই সম্পূর্ন প্রারম্ভিক কৃষি পার্বণের নামই হল রহৈন।
বিশেষ গোষ্ঠীর হয়েও এই পরব দিনের শেষে হয়ে ওঠে আপামর মানবজাতির মঙ্গলার্থে, সার্বিক। সৃষ্টি ও কৃষির অনন্তর প্রতিভু।
বিঃদ্রঃ -- রহৈন ফল ও গাছের ঔষধিগুণ এখন সর্বস্বীকৃত তারও প্রমাণ স্বরূপ (দক্ষিণবঙ্গের ভেষজ উদ্ভিদ সম্পদ -- গবেষণা বিভাগ; বনদপ্তর)বই -র পাতার ইংরেজী ও বাংলা দুটোই দেওয়া রইল চাইলে দেখে নেবেন।