আহাম্মকের গদ্য(পাঁচ)


আহাম্মকের গদ্য(পাঁচ)

ছবিঃ গৌতম মাহাতো


না, ওর সাথে আমার প্রেমের সম্পর্ক নয় আবার বটেও। এ সম্পর্ক যে ঠিক কী তা আমি অন্তত ঠাহর করে উঠতে পারিনি। এ ভাবেই ইস্পাতের তলোয়ারের মত এক একটি রাতের ট্রেন হুইসেল বাজাতে বাজাতে চলে যায় পূব থেকে পশ্চিমে। কখনও সখনও মালগাড়ি এসে দাঁড়ায়। যমদূত। সকালে আর.পি.এফ. আসে জেরা হয় আবার একই ভাবে চলতে থাকে রোদের চাকা। রূপুদিকে একদিন জিজ্ঞেস করেছিলাম

-- আমায় বিয়ে করবে?

ও বলেছিল

-- না।

-- ক্যানো?

-- আমি জেগে উঠতে চাইনা তাই..


    এ এক অনন্ত রঙের বৃত্ত। বৈভবের দেশ। এই জৌলুস ছড়িয়ে যায় আমার ধূলো-মাটির শরীরে। আমিও জেগে উঠতে চাইনা রূপুদি, আমার আচ্ছন্ন দেহ বয়ে চলেছি আজন্মকাল।

        আজকাল সবকিছুই আমার অসুস্থ মনে হয়।কোলাহল আর আলো কেন্দ্রিক যাপন নৈশব্দের রাতগুলোও গ্রাস করতে থাকে দেদার। এখানে এসে বসলে আমার ফুসফুস চাঙ্গা হয়ে ওঠে। মস্তিস্কের ভাঙন সাময়িক থামে। মাটির নিচে শুয়ে থাকা আমাদের পুর্বপুরুষরাও একদিন এমনই আচ্ছন্ন আবহ বহন করেছি। তারপর তাদের রক্ত মাংস অস্থি মিশে গ্যাছে নিয়ত মাটির গর্ভে। আজ তারা চলে গ্যাছে কোন অনন্তের খোঁজে। পাঞ্জাবীর পকেট হাঁতড়ে সিগারেট বের করে ধরালাম। গঞ্জিকার ধোঁয়া  আলপনা আঁকলো সম্মুখ হাওয়ায়। বড্ড বিচিত্র সে স্বাদ। অনেকগুলো বাবল ভেসে যাচ্ছে উত্তরবিল পেরিয়ে রেললাইন পেরিয়ে ঝুমপাহাড়ির দিকে। এবার অবলীলায় এই নিঃসঙ্গতার মাঝে রূপুদিকে নিয়ে আসতে পারি। এলামও নিয়ে। তারপর কত কথা কত আলো! আমার কথা,মুসাফির জিন্দেগীর কথা, রূপুদির বিয়ের কথা, একান্ত যাপনের কথা.. সাঁঝ ডিঙিয়ে রাত- রাত পুইয়ে যায় যায়।রূপুদি আমার মুখে তার রঙ মাখা শীতল আঙুল ছড়িয়ে বলে

-- এ সব ছাই-পাঁশ খাস ক্যানো মুসাফির! 

আমার আড়ষ্ট জিভে রঙ লাগে এ সময়।বলি

--জাগতে চাই না তাই..

-- এ নিদ্রা স্বপ্নের নয়।

-- তবে স্বপ্ন দ্যাখাও! আমার স্বপ্ন যে ফুরিয়ে যায় ইদানিং!

এগিয়ে দ্যায় পিরিচে করে হরেকরকমবা স্বপ্নের হুজুম। ঠোঁট কামড়ে ধরে চাঁদ। রূপদির সাথে মিশে যাচ্ছি ছায়াদের ছায়ায়। শরীর ছেড়ে দিয়েছি শরীরের স্রোতে।রুহ্ ছুঁয়ে আছে রুহের দৌলত। শুধু নূয়ে পড়া আলোয় দেখি তার পিচ্ছিল স্তন শুষে নিচ্ছে নেশাতুর তীক্ষ্ণ ধুলোমাটি। আষ্টেপৃষ্ঠে সে নিজেকে মিশিয়ে দিচ্ছে আমার সাথে, আমার জলজ ছায়ার সাথে। অথচ আমি আর সে খুব কাছাকাছি বসে আছি। আমি ও আমার যে এক নয় এটুকু সত্যিই বা ফেলি কোন ঘাটে! রূপুদির ঐশ্বর্য গড়িয়ে নেমে এলে সে ক্লান্তি ঢেকে নেয় তার উজানি পাহাড়। তার তপ্ত উঠোন আমায় জড়িয়ে শুয়ে আছে অথচ আমরা তখনও তেমনই বসে আছি খুব কাছাকাছি। ভোরের আলোর বিষ আমাদের চিবুক চিকুর ছুঁয়ে দিলে রূপুদি আবরণ টেনে নেয় তার শরীরে। রুহ্ও ফিরে আসে পুরোনো খোলসে আবার। আমি বলি

-- এই আবরণ তো চাইনি মিতান! আমাদের মাঝখানে বায়বীয় সাঁকোটুকু আঁকা হোক আরও সুক্ষ্ম। সু্ক্ষ্মাতিসুক্ষ্ম। কিন্তু পলকা নয়।


    সে তার বাহ্যিক কক্ষে ফিরে যায় আর আমি ফিরে আসি আমার ভেতর, মানে অনঙ্কিত ছবির ভেতর।

        রোজকার মতই রাত পাখা মেলতে মেলতে ওড়া শিখতে চায়। পালক বের হয় আমার নিঃসঙ্গের। তুলিতে রঙ লাগিয়ে বসে থাকি বিহনের চৌকাঠে। যথারীতি কুকুর আবার কুণ্ডলী মেরে বসে আমার ও আমার মাঝখানে। এ ভাবেই ভোর হয় ভোর থেকে সাঁঝ আর সাঁঝ থেকে রাত লাফিয়ে নামে রূপদির কোলে। 

   যদ্দূর মনে পড়ে দোলেরই দিন, কারণ যা রঙ ছিল তার তা দিয়ে নিজেকেই এঁকে ফ্যালা যায়, তাকেও। দুরন্ত রোদের ভেতর নৈঃশব্দের ভেতর এলো সে। কাল থেকে বাবলের মধ্যে ভেসে আছি। ভেসে আছি অনন্তের যানে। নেশা কান চোখ মুখ ও জিভ ছাপিয়ে 

বারংবার আমার মধ্যের আমিকে ছুঁয়ে দিতেই চৌচির কাল। নিকষ অন্ধকারের কুঠরিতে দু ফোঁটা আলো জ্বালিয়ে খুঁজেছি তাকে। সে আসে তবে মুহূর্তকাল মাত্র। আবার খোঁজ খোঁজ..। চোখের তারায় ভেসে ওঠা রঙের বাবল গুনতে গুনতে গুনতে হারিয়ে কখন জানিও না। সে এলো ঠিক আগের মতই। বিভঙ্গ সামলে দাঁড়ানো সাপ। চিকচিকে শরীর, পায়ে সেই শাপলা রঙা চটি। বুঝতে পারছিলাম না কে দুলে উঠছে, আমার সাঁকো নাকি সে! কাছে এলো। খুব কাছে। যেখান থেকে আমার ধুলোমাটি সরিয়ে আমায় ছুঁয়ে ফ্যালা যায় অবলীলায়। কই এর আগে তো রূপুদি এভাবে ছোঁয়নি কখনও! ওষ্ঠের বালু ছড়িয়ে দিচ্ছে তখন আমার ওপর। ঘামের বিন্দু নেয় যাচ্ছে চিবুক হয়ে স্তন,স্তন হয়ে অনন্ত উৎসের দিকে। তবে কি খোঁজের খোঁজ আজ মিটে যাবে হে অনন্ত প্রকাশ। আমাদের মুর্শিদ এসে দাঁড়াবে এবার! সমস্ত বৈভবের ধুলোমাটি ফেলে আমি বসি তার মুখোমুখি। দেখি আমার আগামী ও পুর্বপুরুষের রক্ত-মাংস-অস্থি পড়ে আছে তার শরীরের নিচে। ক্রমশ তৃপ্তির স্রোতে ভেসে উঠছে তার ঐহিক ক্লান্তি। সে কানের কাছে ঠোঁট রেখে বলে

--সাঁকো বাঁধতে দুদিকের ভিত লাগে যে মুসাফির। আর আজ আরও একটি ভিত গড়ে দিলাম মনে রেখো কিম্বা ভুলে যেও।


    আচমকা ফিরে আসি আবার। এ কে তবে? এ কণ্ঠস্বর তো রূপুদির নয়! এ শরীরে বাৎসল্য কই? আমি কিছুই চিন্তে পারছি না। আমি জাত অন্ধ। শুধু মনে হল এই শরীরে কুমারীর ঘ্রাণ।

  ভেতরে তখন মানু বোষ্টুমি গেয়ে ওঠে--


"রাধার নূপুরে বাজে কানাই-র নাম

কি ভাবে সে লুকাইবে প্রেমের প্রণাম

এসো এসো সখী সব যাব যমুনায়

সেখানে বসে আছে সাধের কানাই

ধীরে খুব ধীরে চলো, না জানে আয়ান ঘোষ

নতুন ফুলের গায়ে বরষিবে কলঙ্করোষ"


আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে--

https://lekhajokha-ek-dasaker-goutam-mahato.blogspot.com/2020/12/domination-of-mother-tongue.html


Post a Comment

Oops!
It seems there is something wrong with your internet connection. Please connect to the internet and start browsing again.
AdBlock Detected!
We have detected that you are using adblocking plugin in your browser.
The revenue we earn by the advertisements is used to manage this website, we request you to whitelist our website in your adblocking plugin.
Site is Blocked
Sorry! This site is not available in your country.