আহাম্মকের গদ্য(দুই)
আমার মনে আছে তখন বেলেঘাটার একটি মেসে আমার কিছু বন্ধুদের দৌলতে আকছার যাতায়াত ছিল।সেই সময়ের একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে।মনে পড়ে আর নিজের মনেই হাসি আর ভাবি!!
ওই মেসের আমি ছিলাম এক অকাল-কুষ্মাণ্ড গোত্রিয় অনিবার্য গেস্ট মানে প্রায়ই গিয়ে অন্ন ধ্বংস করতাম ওদের আর কি। ওখানের সব রুমই আমার জন্য ছিল অবাধ ও অমোঘ। সবাই ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র, বেলেঘাটা সেরামিক কলেজের বেশি। কয়েকজন যাদবপুরেরও ছিল।
তো এমনই একদিন পৌঁছে দেখি সবাই কি সিরিয়াস হয়ে সামনে বই খুলে রেখে কেউ নখ কাটছে কেউ গান শুনছে কেউ বা মুড়ি খাচ্ছে...
আমি তো অবাক মেসটার হলটা কি? পেছনেই বেলেঘাটা আই ডি হসপিটালের পাঁচিল।মেসটা বড্ড অদ্ভুত রকমের শান্ত। পাঁচিলে ওপারের লোকজনের চেঁচামেচিও স্পষ্টই শোনা যাচ্ছিল সেদিন। ভয় পাওয়ার মত একটা নিস্তব্ধতা। জিজ্ঞেস করলাম কেসটা কি?? বন্ধুটি যা জানাল তা সত্যিই চিন্তার বিষয়। পরের দিন পেপার ১-র পরীক্ষা। আমিও চুপচাপ খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়লাম। পাশের বেডে সুমন(যে এখন জম্মু-কাশ্মীর আই আই টির ফ্যাকাল্টি) টেবিল ল্যাম্প জালিয়ে গাঁতিয়ে পড়ছে।আর তার চোখে মুখে সারা বছর না পড়ার সব তাকত সঞ্চারিত হচ্ছে গাতানোর কৌশলে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না হঠাৎ ভোর সাড়ে আটটার দিকে চিল চিৎকারে ঘুমটা ভেঙে গ্যালো।দেখি রাস্তার দিকের কলতলার গায়ের রুমটাতে বিশাল তর্কাতর্কি হচ্ছে।প্রথমে ভাবলাম হয়তো বাইরের কারুর সাথে লেগেছে হয়তো।পরে সম্বিৎ ফিরতে বুঝলাম না না,নিজেদের মধ্যেই লেগেছে।আবার সেই আগের বাতাবরন। মেস জুড়ে সেই চাঞ্চল্য সেই চিৎকার সেই গান সেই উন্মাদনা। পুরো ১৮০ডিগরি ঘুরে গ্যাছে গতদিনের পরিস্থিতি থেকে। দুটো মেলাতে পারছিলাম না।কি হচ্ছে এমন যা সব অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে গ্যালো রাতারাতি! পরীক্ষা তো ১২টা থেকে, তখনও বাকি! কিছুটা কৌতুহল বশতই গেলাম।গিয়ে শুনে যা বুঝলাম তাতে আরও আশ্চর্যের নমুনা খুলে গ্যালো।সেখানে বিতর্ক সভা চলছে ব্রাস করতে করতে।বিষয় বাঘ বড় না সিংহ বড়।তাতে কি অকাট্য অকাট্য যুক্তির অবতারণা হচ্ছে ভাবতেও অবাক হতে হয়।
প্রসূন বলছে -- বাঘ হল জাতীয় পশু। সিংহ কি জাতীয় পশু?
সুমন-- আরে ছাড় তোর বাঘ! ভারী বাঘ দেখাচ্ছে! সিংহ হল বনের রাজা।বাঘকে কেউ বনের রাজা বলে? শুনেছিস কস্মিনকালেও?
প্রসেঞ্জিত--আারে বাঘের গায়ের ওই ডোরাকাটা দাগ আসলে চরম নান্দনিকতার পরিচায়ক।যা একমাত্র বাঙালিকেই রি প্রেজেন্ট করে।
সঙ্গে সঙ্গে সুজয় রে রে করে উঠল
সুজয়-- আহাহাহাহ বাঙালির পেটন্ট নেওয়া গনিমতের মাল রে আমার... সংস্কৃতে আছে কেশরং দ্বীপিনং হন্তি। এত বড় বড় মহাকবিরাও সিংহে সৌন্দর্যের বর্ণনা পাতার পর পাতা জুড়ে করে গ্যাছেন,তা কি এমনি এমনি!! প্রাচীন সাহিত্য টাহিত্য একটু পড় বাওয়া।নইলে নান্দনিকতার পরাকাষ্ঠা হবে কি করে!!
আমি তো মাথা ঘুরে পড়ে যাচ্ছিলু্ম শালা কোথায় কেশর আর কোথায় দ্বিপ তাও আবার হন্তি! দ্বিপকে কেশরের জন্য হত্যা!! কোন মহাকবি লিকেছেন কে জানে সেটা ওই জানে আর ওর মহাকবিই জানে! কিন্তু নাহ, আমি মজা নেওয়ার জন্য নো- কমেন্টের ঘরেই থেকে গেলাম। কারণ জানি ওটা এই যুযুধান পরিস্থিতিকে ব্যহত করবে। তা আরও বেশ খানিক চলার পর পাশে নিজামকে জিজ্ঞেস করলাম --
তোদের ১২টা থেকে নাকি পরীক্ষা যে?
ও ঠিক ততটাই নির্লিপ্ত থেকে জবাব দিল --তার জন্যই তো সময় কাটাচ্ছি!
বুঝলাম বাঙালি বিচিত্র জীব।আনন্দ হোক বা মহামারি, সুখ হোক বা চরম অনিশ্চয়তা সব কিছুকে সব মুহূর্তকে এক ঝটকায় নস্যাৎ করার ক্ষমতা রাখে আড্ডা।
"তাই আড্ডা বাবা অমর রহে
ওঠা পড়া সব আবহে"
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন--